বিপ্লব দে,চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের জায়গায় এলোপাতাড়ি দোকান বানিয়ে বিক্রি করে মাত্র এক বছরে শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন জামাতের অর্থযোগান দাতা প্রতিষ্টান শামীম কর্পোরেশনের ” শামীম” নামের ব্যবসায়ী। এ কাণ্ডটি ঘটেছে নগরের অন্যতম বিপণিকেন্দ্র চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্সে। অভিযোগ আছে, রিয়াজউদ্দিন বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ইসমাইলের সঙ্গে সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।
এই ঘনিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে তার সময়ে চসিকের কাছ থেকে বিপণিবিতানের সৌন্দর্যবর্ধন ও আধুনিকায়নের কাজ হাতিয়ে নেন ইসমাইল। এরপর বিপণিবিতানের আলো-বাতাস চলাচলের জন্য রাখা নির্ধারিত ফাঁকা জায়গা ও পার্কিংয়ে দোকান গড়ে তোলেন তিনি। ফলে দৃষ্টিনন্দন বিপণিবিতানটি গুদামে পরিণত হয়েছে।
ইসমাইলের এমন কাণ্ডে ব্যবসায়ীদের আপত্তিকেও আমলে নেননি তৎকালীন মেয়র। ‘অপরিকল্পিত’ এসব স্থাপনা নির্মাণে নেওয়া হয়নি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) কোনো অনুমোদনও। এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিপণিবিতানটির স্থপতি সোহেল মো. শাকুর। ভবনটি সম্প্রসারণের জন্য পর্যাপ্ত ভিত্তি নেই বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেন, চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে বিপণিবিতানের ভেতরে আলো-বাতাস চলাচলের জন্য রাখা উন্মুক্ত স্থান ও গাড়ি রাখার জায়গায় দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। সরেজমিন পরিদর্শন করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নির্মাণকাজ বন্ধ রাখতে বলেছি। বিশেষজ্ঞদের দিয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটি নির্মাণ ত্রুটি ও ভিত ছাড়া ভবন সম্প্রসারণের কারণে পরবর্তীকালে কোনো বিপর্যয় হবে কিনা তা যাচাই করে দেখে প্রতিবেদন দিলে পরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইসমাইল ৩০০ দোকান বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছেন ১২০ কোটি টাকা: সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট নগরের ষোলশহর চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্সের সৌন্দর্যবর্ধন ও আধুনিকায়নের জন্য শামীম করপোরেশনকে বরাদ্দ দেয় সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগ। অনুমোদন পেয়ে কোনো ধরনের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ না করেই বিপণিবিতানটির আলো-বাতাস চলাচলের জন্য রাখা খোলা জায়গা ও পার্কিংয়ে দোকান নির্মাণ শুরু করেন শামীম করপোরেশনের কর্ণধার মুহাম্মদ ইসমাইল।
নির্মাণের আগেই নকশা দেখিয়ে দোকান বিক্রিও শুরু করেন তিনি। বিপণিবিতানটিতে বর্তমানে দোকান রয়েছে ৩৭৫টি। নতুন করে আরও তিন শতাধিক দোকান নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিটি দোকান গড়ে বিক্রি হচ্ছে ৪০ লাখ টাকা করে। এর মধ্যে নিচতলায় প্রথম সারির দোকানগুলো ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে বলে বিপণিবিতানটির ব্যবসায়ীরা জানান। সে হিসাব অনুযায়ী, ৩০০ দোকান বিক্রি করেছেন ১২০ কোটি টাকার বেশি। বিপরীতে সিটি করর্পোরেশন পেয়েছে নামমাত্র রাজস্ব। বাকি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ইসমাইল।
বিপণিবিতানের নির্ধারিত খোলা জায়গা ও পার্কিংয়ে দোকান: বিপণিবিতানের চারটি উন্মুক্ত স্থানের তিনটিতে দোতলার কাজ শেষ হয়েছে। অন্যটিতেও স্টিলের পাত স্থাপন করা হয়েছে। তিনতলার কাজ চলছে। এর মধ্যে চারতলা পর্যন্ত স্টিলের কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। কোনো ভিত ছাড়া বিদ্যমান দোতলা ভবনটি বর্ধিত করে তিনতলার নির্মাণকাজও চলছে।
এছাড়া বিপণিবিতানের গাড়ি রাখার জায়গায়ও কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। এতে গাড়ি রাখার জায়গা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বিপণিবিতানে আসা ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের গাড়ি রাখা হচ্ছে ফুটপাত এবং সড়কে। ফলে বিপণিবিতানটির সামনে নগরের প্রধান বহদ্দারহাট-বিমানবন্দর সড়কে যানজট যেমন তৈরি হচ্ছে, তেমনি পথচারীরা সড়কে হাঁটতে গিয়ে তৈরি হচ্ছে জীবনের ঝুঁকিও।
এ বিষয়ে জানতে শামীম করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী মুহাম্মদ ইসমাইলের মোঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেনি।
নিয়ম লঙ্ঘন করে বরাদ্দ: বিপণিবিতানটির জমির মালিক চউক। নব্বইয়ের দশকে এটি ভাড়া নিয়ে মার্কেট নির্মাণ করে চসিক। এর বিপরীতে প্রতি বছর চউককে ভাড়াও দিয়ে আসছে চসিক। ভাড়ার শর্ত অনুযায়ী বিপণিবিতানটির সংযোজন-বিয়োজন করতে হলে লাগবে চউকের অনুমতি। কিন্তু গত বছরের আগস্টে কোনো অনুমতি ছাড়া প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মুফিদুল আলম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে শামীম করপোরেশনকে সৌন্দর্যবর্ধন ও আধুনিকায়নের নামে স্থাপনা নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। অনুমতি ছাড়া স্থাপনা নির্মাণ করায় সিটি করপোরেশনকে এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছে চউক।
এ প্রসঙ্গে চউকের ভারপ্রাপ্ত সচিব সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, ভাড়ার শর্ত ভঙ্গ করে বিপণিবিতানটিতে স্থাপনা নির্মাণ করায় কাজ বন্ধ করতে সিটি করপোরেশনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এদিকে ইমারত নির্মাণ আইন অনুযায়ী, কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে হলে চউকের কাছ থেকে ভূমি ছাড়পত্রসহ নকশা অনুমোদন নিতে হয়। বিপণিবিতানটির বর্ধিত স্থাপনা নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোনো অনুমোদন নেননি।
ক্ষুব্ধ বিপণিবিতানটির স্থপতি, বিপর্যয়ের আশঙ্কা: বিদ্যমান বিপণিবিতানটি একতলা পরিত্যক্ত গুদামঘর ছিল। নব্বইয়ের দশকে চউকের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে সেখানে বিপণিবিতান নির্মাণ করে সিটি করপোরেশন। সেই সময় গুদামটি পুনঃসংস্কার করে বিপণিবিতানের নকশা তৈরি করেন স্থপতি সোহেল মো. শাকুর। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, নিজের নকশায় তৈরি একটি স্থাপনা নষ্ট করেছে শুনে খুব খারাপ লাগছে।
ভবনটি একতলা গুদাম ছিল। সেটি সংস্কার করে দোতলা বিপণিবিতান করা হয়েছিল তখন। ভবনটির পর্যাপ্ত ফাউন্ডেশন (ভিত) না থাকায় দ্বিতীয় তলা সম্প্রসারণে তখনই আপত্তি উঠেছিল। বর্তমানে ভবনটির যে ভিত আছে তা সম্প্রসারিত অংশের ওজন আদৌ বহন করতে পারবে কিনা সেটা যাচাই না করে সম্প্রসারণ করা হলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে।
ফুটপাতেও ইসমাইলের ২০ দোকান: চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্স ছাড়াও নগরের তিনটি এলাকার সৌন্দর্যবর্ধনের দায়িত্ব পান মুহাম্মদ ইসমাইল। নগরের ইস্পাহানী মোড় থেকে টাইগারপাস মোড়, জিপিও থেকে পুরাতন রেলওয়ে স্টেশন ও নিউমার্কেট মোড় থেকে আমতলী এবং প্রবর্তক মোড় থেকে গোলপাহাড় মোড় পর্যন্ত সৌন্দর্যবর্ধনের দায়িত্ব পান তিনি। স্ট্ক্রিপ্ট ও অডিওস ইঙ্ক নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে কাজগুলো নেওয়া হয়।
এর মধ্যে অডিওস ইঙ্কের মালিকও ইসমাইল ও তার ভাই মো. আহাদ। সৌন্দর্যবর্ধনের আড়ালে ফুটপাতে এখানে ২০টি দোকান নির্মাণ করেছেন তারা। মানুষ চলাচলের জন্য নির্ধারিত ফুটপাতের দোকানগুলোও প্রতিটি সর্বনিম্ন পাঁচ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে।