জেনারেল হাসপাতালে আড়াই কোটি টাকা আত্মসাৎ : খোজ মেলেনি প্রকাশের

প্রকাশঃ ২০২১-১০-০১ - ১৮:৪০

তদন্তে বেরিয়ে আসতে পারে থলের বিড়াল

মামলায় অনুমতির অপেক্ষায় দুদক

স্বাস্থ্য দপ্তরের নিদের্শনা অপেক্ষায় : বিভগীয় পরিচালক

কামরুল হোসেন মনি : ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট প্রকাশ কুমার দাসের গত ৮ দিনেও হদিস মেলেনি। করোনা টেস্টের ২ কোটি ৫৭ লাখ ৫৭ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাতের অভিযোগের পর থেকে লাপাত্তা হয় সে। গত বৃহস্পতিবার ( ২৩ সেপ্টেম্বর) থেকে দুপুরের পর থেকে সে গা ঢাকা দিয়ে আছে। টাকা আত্মসাতের ঘটনায় সঠিক তদন্তে হলে বেরিয়ে আসতে পারে থলের বিড়াল।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলার অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছেন। খুলনার উপ-পরিচালক মোঃ নাজমুল হাসান বৃহস্পবিার এ প্রতিবেদককে বলেন, খুলনা সিভিল সার্জনের দায়ের করা জিডি ও লিখিত অভিযোগটি ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এখন আমরা নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি, অনুমতি স্বাপেক্ষে মামলা দায়ের প্রস্তুতি নেয়া হবে।
খুলনা বিভাগীয় (স্বাস্থ্য) পরিচালক ডা: জসিম উদ্দিন হাওলাদার বৃহস্পতিবার দুপুরে এ প্রতিবেদককে বলেন, ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ল্যাব টেকনোলজিস্ট প্রকাশ কুমার দাসের বিরুদ্ধে করোনা টেস্টের আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়ে খুলনা সিভিল সার্জন তাকে দাপ্তরিক পত্রের মাধ্যমে জানিয়েছেন। বিষয়টি তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে লিখিতভাবে অবহিত করেছেন। পরিবর্তী উদ্ধর্তন কর্তৃপক্ষের দিক-নিদের্শনার অপেক্ষায় আছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
খুলনা সিভিল সার্জন ডা: নিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, এখনো ল্যাব টেকনোলজিস্ট প্রকাশ কুমার দাসের হদিস পাওয়া যায়নি। সে যাতে দেশ ত্যাগ করতে না পারে সে বিষয়ে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশানর (কেএমপি)কে পত্র দিয়ে অবহিত করেছি। এখন স্বাস্থ্য্য অধিপ্তরের নিদের্শনা অপেক্ষায় আছি, পরবর্তীতে কি ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।
হাসপাতালে সূত্র মতে, হাসপাতালের ইউজার ফি সঠিকভাবে নিরুপনের জন্য গত ২২ আগষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। খুলনা সিভিল সার্জন ডা: নিয়াজ মোহাম্মদকে প্রধান করে ৫ সদস্য তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। গঠিত কমিটি গত ১৬ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন দাখিল করে। তদন্তে বেরিয়ে আসে ২০২০ সালের জুলাই থেকে চলতি (২০২১) বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত করোনা পরীক্ষার ইউজার ফি বাবদ মোট ৪ কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা আদায় হলেও সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৬৬ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। ল্যাব টেকনোলজিস্ট ও ল্যাব ইনচার্জ প্রকাশ কুমার দাস বাকি ২ কোটি ৫৭ লাখ ৯৭ হাজার টাকা জমা দেননি। ওই টাকা কেন সরকারি কোষাগারে জমা দেননি তার জবাব দেয়ার জন্য গত ২০ সেপ্টেম্বর কৈফিয়ত তলব করা হয়। কিন্তু দু’দিন অতিবাহিত হওয়ার পর গত ২৩ সেপ্টেম্বর দুপুরের পর থেকে মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট (ল্যাব:) প্রকাশ কুমার দাস গা ঢাকা দেন। ওইদিনের পর থেকে তার ব্যবহৃত মোবাইলও বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর গত ৮ দিন অতিবাহিত হলেও তার কোন হদিস পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনায়  কেএমপির খুলনা থানায় জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট প্রকাশ কুমার দাসের বিরুদ্ধে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনে খুলনার সিভিল সার্জন ডা: নিয়াজ মোহাম্মদ ২৭ সেপ্টেম্বর  (সোমবার) রাতে একটি সাধারণ ডায়রি করেছেন। যার নম্বর-১৬০১, তারিখ-২৭/৯/২১ইং।
ল্যাব টেকনোলজিস্ট প্রকাশ কুমার দাসের স্ত্রী মাধবী লতা শহীদ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে ফার্মাসিষ্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশের স্ত্রী মাধবী লতা এ প্রতিবেদককে বলেন, গত বৃহস্পতিবার থেকে তার স্বামী প্রকাশের সাথে আর যোগাযোগ হয়নি। তার ব্যবহৃত মোবাইলও বন্ধ রয়েছে। তার স্বামীর বিষয়ে খোজ খবর নিতে তাকে সিভিল সার্জন অফিস থেকেও ফোন করা হয়। কিন্তু তার স্বামীর কোথায় আছেন তিনি জানেন না।
এদিকে, বিগত এক বছরেরও  বেশি সময় ধরে আদায়কৃত ইউজার ফি সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে কিভাবে ল্যাব ইনচার্জ মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট প্রকাশ কুমার দাসে আত্মসাৎ করলেন তা নিয়েও নানান গুঞ্জন শুরু হয়েছে। বিশেষ করে তার উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টিকে কেন এতোদিন কোন গুরুত্বের সাথে দেখেননি সেটি নিয়েও দেখা দিছে নানান প্রশ্ন। যা দায়িত্ব অবহেলার সামিল। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে এর দায়ভার সিভিল সার্জন যেমন এড়িয়ে যেতে পারেন না, তেমনি দায় এড়াতে পারেন না হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা: এস এম মুরাদ হোসেন। এ ব্যপারে সিভিল সার্জন ডা: নিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, দুদক তদন্ত করে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাবেন ব্যবস্থা নেবেন। সেক্ষেত্রে যেই-ই জড়িত থাকুক না কেনো।
হাসপাতালের নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, হাসপাতালের কয়েকজন ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরেই অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে জড়িত। যারা এসব দুর্নীতি-অনিয়মের সাথে জড়িত তাদের মধ্যে কেউ কেউ আগে থেকেই স্ব-ইচ্ছায় অন্যত্র বদলী হয়ে গেছেন। এর মধ্যে হাসপাতালের প্রধান সহকারি কাম হিসাবরক্ষক মো: শাহিন মোল্ল্যা গত ৪ আগষ্ট মাসে দায়িত্ব হস্তান্তর করে বদলী হন। তিনি নিজের দোষ ধামাচাপা দেওয়ার জন্য স্ব-ইচ্ছায় বদলী নিয়েছেন। দায়িত্ব থাকা অবস্থায় প্রধান সহকারি কাম হিসাবরক্ষক মো: শাহিন মোল্ল্যা বিরুদ্ধেও নানা অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে যা আস্তে আস্তে অনেকেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন। সার্বিক দিক বিবেচনায় এনে এটি নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করা হলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে পারে বলেও একাধিক সূত্র জানায়। করোনার টেস্টের টাকা সরকারে কোষাঘারে সঠিক ভাবে জমা হতো কি না তা দেখভাল করতেন হাসপাতালের আরএমও ডা: এস এম মুরাদ হোসেন।
জানা গেছে,  করোনা শুরুর প্রথম দিকে করোনা টেস্টের জন্য সাধারণ মানুষদের বাসায় গিয়ে করোনা টেস্টের জন্য হাসপাতালের থেকে যাদের শ্যাম্পল কালেকশনের পাঠাতেন তারেকে দিতে হতো ১ হাজার টাকা করে এবং হাসপাতালে এসে করোনা টেস্টের করালে  নেওয়া হতো ৫০০ টাকা।  দীর্ঘ কয়েক মাস এভাবে চলার পর পরবর্তীতে নেয়া শুরু করে ৩০০ ও ৫০০ টাকা। এর কয়েক মাস পরে হাসপাতালে আসা সাধারণ মানুষের করোনা টেস্টের জন্য নেয়া হতো ১০০ টাকা। তখন বাসা বাড়িতে গিয়ে সাধারন মানুষের করোনা টেস্টের শ্যাম্পল নেয়া বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষনা থাকলেও গোপনে তা টাকার বিনিময়ে নেয়া হতো। এছাড়া বিদেশগামীদের সাড়ে ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা করোনা টেস্টের জন্য নেওয়া হতো। এসব কিছুর দায়িত্বে ছিলেন ল্যাব ইনচার্জ মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট প্রকাশ কুমার দাসের। পাশাপাশি তিনি হাসপাতালের হাসপাতালে প্যাথলজির ল্যাব ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করতেন।
এব্যাপারে বৃহস্পতিবার রাতে ২৫০ শয্যা হাসপাতালের সাবেক প্রধান সহকারি কাম হিসাবরক্ষক মো: শাহিন মোল্ল্যাকে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, তিনি স্ব-ইচ্ছায় বদলী নেননি। জনস্বার্থে কর্তৃপক্ষ তাকে বদলী করেছেন। তিনি কোন হাসপাতালে দুর্ণীতির সাথে জড়িত নন বলে দাবি করেন। করোনা টেস্ট এবং প্যাথলজিস্ট বিভাগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার টাকাগুলো সংগ্রহ হওয়ার পর হাসপাতালের ক্যাশিয়ার তপতী সরকারের কাছে বুঝিয়ে দিতেন যারা ওই সব কাজে দায়িত্বরত ছিলেন। তাদের কাছ থেকে ওই ক্যাশিয়ার টাকাগুলো নিয়ে ট্রাজারের মাধ্যমে ব্যাংকে জমা দেন। সেই চালানের কপি ক্যাশিয়ার সংগ্রহণ করে রাখেন। আমার কাছে কখনো জমা দেননি। এমনকি টেস্ট অনুযায়ী মেডিকেল টেকনোলজিস্ট প্রকাশ কুমার দাস টাকা দিচ্ছেন কি না এ বিষয়ে ক্যাশিয়ার তপতী সরকার কোন অভিযোগ দেননি। হাসপাতালের এসব দেখা শোনা করতেন হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ। কে দেখাশোনা করতেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আরএমও ডা: এস এম মুরাদ হোসেন। বর্তমানে মো: শাহিন মোল্ল্যা যশোরে অভয়নগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রধান সহকারি কাম হিসাবরক্ষক হিসেবে দায়িত্ব রয়েছেন।
এ ব্যাপারে হাসপাতালের ক্যাশিয়ার তপতী সরকার বৃহস্পতিবার রাত ৭টায় এ প্রতিবেদককে বলেন, করোনা টেস্টে অনুযায়ী যখন টাকাগুলো আমার কাছে যখন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট প্রকাশ কুমার দাস জমা দিচ্ছিলো না। বিষয়টি তখন আমি তৎকালীন হাসপাতালের প্রধান সহকারি কাম হিসাবরক্ষক মো: শাহিন মোল্ল্যাকে মৌখিকভাবে অবহিত করি। তিনি বিষয়টি আরএমওকে অবহিত করেছেন। পরে সিভিল সার্জন আমাকে এই অভিযোগের বিষয়টি লিখিতভাবে দিতে বলেন, তখন আমি লিখিতভাবে অভিযোগ দেই।
সাবেক সিভিল সার্জন ডা: সুজাত আহমেদ বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদককে বলেন, তিনি দায়িত্ব থাকা অবস্থায় হাসপাতালে করোনা টেস্টসহ ল্যাবের যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার টাকা সঠিক ভাবে সরকারে কোষাগারে জমা হচ্ছে কি না তা আরএমও ডা: মুরাদ হোসেন দেখা শোনার দায়িত্বে ছিলেন। ওই সিভিল সার্জন বর্তমানে গোপালগঞ্জে সিভিল সার্জন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এব্যাপারে হাসপাতালের আরএমও ডা: এস এম মুরাদ হোসেনকে সন্ধ্যা ৬টায় একাধিকবার তার ব্যবহৃত মোবাইলে ফোন দেওয়া হলে তিনি তা রিসিভ করেননি।