এসএম জামাল, কুষ্টিয়াঃ টাকা ছাড়া রোগীর ছাড়পত্র দিতে নারাজ কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের নার্সরা। ছাড়পত্র নিতে নার্সদের চাহিদা মাফিক টাকা না দিলে রোগী ও স্বজনদের গালমন্দও শুনতে হয় এমনই অভিযোগ করেছেন চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও সাথে আসা স্বজনরা।
গত মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে গিয়ে সরেজমিনে দেখা যায় রুকাইয়া নামের এক বছরের শিশু রোগী কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার মা। কথা বলে জানাগেল, বমি আর পাতলা পায়না শুরু হলে গত শনিবার শিশুটিকে ভর্তি করা হয় । সকালে চিকিৎসক তাকে রিলিজ দিয়ে বাড়ীতে পাঠানোর কথা বলে। দুপুর ১২ টার দিকে ডায়রিয়া ওয়ার্ডের ইনচার্জ ছাড়পত্র দিতে একশো টাকা দাবী করে। রোগীর স্বজন ব্যাগপত্র গুছিয়ে সিএনজিতে বাড়ী যাবে কিন্তু অতিরিক্ত টাকা না থাকায় সেই একশো টাকা দিতে অপারগ প্রকাশ করে। পরে নার্সরা জানায় টাকা ছাড়া ছাড়পত্র দেওয়া যাবে না। তখন বাধ্য হয়ে রোগীর স্বজন ৫০ টাকা দিয়ে ছাড়পত্র গ্রহণ করে। পরে বিষয়টির সত্যতা জানতে কর্তব্যরত নার্সের সাথে কথা বললে জানান,এই ৫০ টাকা নার্স ইনচার্জ রেনুকা নিতে বলেছে।
সেখানে বেশ কয়েকজন রোগী ও রোগীর সাথে আসা স্বজনরা অভিযোগ করে জানান,রিলিজের সময় টাকা দিয়ে তবেই রোগীর ছাড়পত্র নিতে হয়। শুধু তাই নয়, ডায়রিয়া ওয়ার্ডে নার্স হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করে থাকে তারা একটু বেশিই বিরক্ত হয়ে থাকেন। কারওবা মেজাজ খিটখিটে থাকে সবসময়।
মিরপুরের শায়লা বেগম জানান, সকালে রাউন্ডের ডাক্তার এসে শিশুকে ডায়াসল স্যালাইন লিখে দেন। পরে রোগী স্যালাইন বাইরে থেকে কিনে আনবে কি না নার্সের সাথে আলাপ করতে গেলে বলেন স্যালাইন শরীরে পুশ করা লাগবে না। আরেক শিশুর মা জানান, গত রোববার সন্ধ্যার সময় আমার শিশুর শরীরে স্যালাইন পুশ করার কিছুক্ষণ পর কাপুনি উঠছিলো। তিনবার নার্সকে ডাকলেও আসেননি। পরে অনেক অনুরোধে আসলেও স্যালাইন শরীরে পুশ না করে বন্ধ করে দেয়। এবং নার্সরা রোগীর স্বজনদের সাথে খারাপ আচরণ করে। শুধু তাই নয়, এক নার্স বলেই বসেন আমাদের ১২ জনের বেশি রোগী দেখা কোন নিয়ম নেই!
গত রোববার রাত সাড়ে ৯টায় কুষ্টিয়ার বলিদাপাড়া গ্রামের সেরেনা নামের এক রোগী জরুরী বিভাগে আসলে তাকে না দেখেই তার কোন চিকিৎসা হবে না বলে জানান কর্তব্যরত জরুরী বিভাগের চিকিৎসক। পরে পুলিশ ক্যাম্পের অনুরোধে সেই অসুস্থ রোগীকে দেখেন এবং হাসপাতালে ভর্তি করে। যদিওবা সেই চিকিৎসক আবার রোগীর স্বজনের কাছে স্যরি বলেছেন বলে জানান।
বুধবার দুপুরের হাসপাতালের ৩নং মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডের সামনে কথা হয় ফকিরা বাদ গ্রামের মোজাহার উদ্দিন এসেছিলেন স্ত্রী শুকজান (৫৫) কে চিকিৎসা করাতে। চিকিৎসার পর সকালে ডাক্তার দেখে রিলিজ করে দিয়েছে। কিন্তু ছাড়পত্র নিতে গিয়ে কাছে বাড়ি যাওয়ার ভাড়া ছাড়া আর অতিরিক্ত টাকা নেই তার কাছে। নার্সের দাবি ১ শ টাকা পরে অনুরোধে ৫০ টাকায় ছাড়পত্র দিয়েছে। শুধু মোজাহার উদ্দিনই নয় সেখানে আরো বেশ কয়েকন একই অভিযোগ করেন।
পাশেই আরেক মেডিসিন ওয়ার্ড (পুরুষ) সেখানে শাওতা গ্রামের নজরুল, তোফাজ্জেলসহ বেশ কয়েক জন জানান, ছাড়পত্র নিতে নার্সদের ৫০ টাকা থেকে ১শ টাকা দিতে হয় এটা নতুন কিছু নয়। বেশী ভাড়াবাড়ি করলে নার্সরা বলে ৩ টার পরে এসে ছাড়পত্র নিয়ে যাবেন তখন আমরা থাকবো না।
কবুরহাটের মশিউরসহ বেশ কজন অভিযোগ করে জানান, চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীরা এক প্রকার জিম্মি হয়েই থাকতে হয় নার্সদের কাছে। রাতের কুষ্টিয়া যখন নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে তার সাথে সাথে নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে এখানকার চিকিৎসা সেবা। দায়িত্বরত নার্সরা তখন গভীর ঘুমে মগ্ন থাকেন। হাসপাতালে ভর্তি থাকা রুগীরা যখন বেডে শুয়ে যন্ত্রনায় কাতরাতে থাকেন তখন রোগীর স্বজনরা রোগীকে সুস্থ্য করার জন্য দায়িত্বরত নার্সদের কাছে ছোটাছুটি করে উল্টো চোখ রাঙ্গানি খেতে হয় । অসহায়ের মত তবুও তারা তাদের কাছে আকুতি জানায় চিকিৎসা সেবা নেওয়ার জন্য। হাসপাতালের ওয়ার্ডে গেলে প্রায় রোগীদের একই অভিযোগ রাতের বেলা সেলাইন ও ইঞ্জেকশন পুশ করার জন্য নার্সদের খুজে পাওয়া যায়না। তারা তাদের ডিউটি রেখে ঘুমে বিভোর কিংবা মোবাইলে খোঁশ গল্পনিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
হাসপাতালের ৩ মেডিসিন ওয়ার্ডের ভর্তি থাকা এক রোগী অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতালের নার্সদের দুব্যবহার এটা নতুন কিছুনা রাতে ডিউটি থাকা নার্সদের । তাদের বেশী ডাকাডাকি করলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং রোগীর সাথে অশোভনীয় আচরন করে। এভাবেই নার্সদের খামখেয়ালীপনা ও নানা অনিয়মের জর্জরিত হয়ে পড়েছে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা।
রোগীদের অভিযোগ ৫০-১০০ টাকা ছাড়া ছাড় পত্র দেন না দায়িত্বরত নার্সগণ। অন্যদিকে ট্রলি ধরার থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি কাজের জন্য আয়াদের দিতে হয় ৩০-৫০ টাকা। খোজ নিয়ে জানা গেছে হাসপাতালে এক শ্রেণীর নার্স যুগের পর যুগ একই স্থানে কর্মরত থাকায় তারা ঠিক মত ডিউটে না আসা এবং এলেও কিছু সময় পর চলে যায়। এছাড়া যতক্ষন ডিউটে থাকেন খোশগল্পে ব্যস্ত থাকেন। ওই সময় কোন রোগী বা স্বজনরা তাকে ডাকলেই উল্টো পাল্টা কথা শুনতে হয়। আর তাদের কারনেই হাসপাতালে সেবার এই দৈন্যদশা। এদিকে ডাক্তারের সংকট ও দায়িত্বরত অবস্থায় নার্সদের খামখেয়ালীপনায় দিন দিন ভেঙ্গে পড়ছে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা।
২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা: আবু হাসানুজ্জামান বলেন, সরকারী হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে বা ছাড়পত্র নিতে রোগীদের কোন প্রকার টাকা পয়সা লাগবে না। যদি কেউ নিয়ে থাকেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।