অশ্বিনী কুমার ক্রুঙ্গু : অনুচ্ছেদ ৩৭০/৩৫এ বাতিল করার পর কেন্দ্রশাসিত জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলে পঞ্চায়েতি শাসন ব্যবস্থার অধীনে জেলা পরিষদ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন এবং এর সম্প্রসারণ ছিল তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্র ও প্রশাসন চালু করার লক্ষ্যে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। অন্য কথায়, এর অর্থ হল প্রশাসনকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রত্যন্ত কোণে বসবাসকারী মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া। যদিও প্রথমবারের মতো জম্মু ও কাশ্মীরে তিন স্তরের পঞ্চায়েত শাসন বাস্তবায়িত হয়েছে, তবুও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের লোকেরা নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়ায় অভিজ্ঞ এবং দায়িত্বশীল নাগরিক ও ভোটারদের মত সাড়া দিয়েছে।
জম্মু ও কাশ্মীরের জেলা উন্নয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রথম চার ধাপের উৎসবে গণতন্ত্রেরই জয় হয়েছে। ভোটারদের উৎসাহ এবং অংশগ্রহণ তারই প্রতিফলন করেছে। সেই সাথে স্বাভাবিক এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য সন্তোষজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
ভোটের শতকরা হার বলে দিচ্ছে যে, ভোটাররা তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। তীব্র শীত, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি এবং উপত্যকায় রাজনীতি বর্জনের পটভূমি সত্ত্বেও জম্মু ও কাশ্মীরে শতকরা ৫০ ভাগ ভোট কোনও অংশেই কম অর্জন নয়। এজন্য সরকার, রাজনৈতিক দলগুলো, নিরাপত্তা বাহিনী এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা ও আচরণ প্রশংসার দাবি রাখে।
আজাদী, স্বায়ত্তশাসন এবং ধারা ৩৭০/৩৫এ- যেসবের জন্যে প্রায় এক লাখ মানুষের জীবনহানি হয়েছে সেগুলিকে সম্ভবত জম্মু ও কাশ্মীরের মাটির গভীরে সমাহিত করা হয়েছে, চিরতরেই। জেলা উন্নয়ন পরিষদ, ব্লক উন্নয়ন পরিষদ ও পঞ্চায়েত নির্বাচনের মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণ ইতোমধ্যেই পাকিস্তান এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে উপযুক্ত জবাব দিচ্ছে এবং আগামীতেও দেবে। পূর্ববর্তী শাসকদের দ্বারা সৃষ্ট সমস্যা সত্ত্বেও স্বাধীনতার সাত দশক পরে পঞ্চায়েত শাসনের তিন স্তরের ব্যবস্থাটি চূড়ান্তভাবে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে শিকড় ধারণ করেছে। এই শাসকরা তাদের আলাদা পরিচয় নির্বিশেষে, এটা নিশ্চিত করেছে যে ক্ষমতা তাদের হাতেই কেন্দ্রীভূত থাকবে এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ একটি সুদূর স্বপ্ন হয়েই রয়ে গিয়েছিল। এটা অবশ্যই গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক ঐতিহ্য সম্পর্কে তাদের অভিপ্রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
এই নির্বাচন রাজ্যের তথাকথিত বিশেষ মর্যাদা বিলুপ্তির একটি বড় ইতিবাচক প্রভাব। তাছাড়া, এটি কোনও বৈষম্য ছাড়াই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু ও কাশ্মীরের সকল নাগরিককে নাগরিকত্ব এবং ভোটাধিকার দিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের শরণার্থী নাগরিক, বাল্মীকি সমাজ, গোর্খা এবং সমাজের অন্যান্য অংশ এই প্রথমবারের মতো জম্মু ও কাশ্মীরের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে শাসনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নির্বাচন করার জন্য ভোটার হয়ে উঠছে।
আশা করি, এই নির্বাচন এভাবেই শান্তি, অগ্রগতি, উন্নয়ন এবং সম্প্রীতির পথ সুগম করবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ইতিবাচক ইতিহাস তৈরির জন্য জম্মু ও কাশ্মীরকে নতুন পথে নিয়ে এসেছে। “ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়” প্রবাদটি প্রমাণ করে সরকার এবং প্রশাসন এই সময় কিছু অতুলনীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা আগেও নেওয়া যেতে পারত।
রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনী প্রক্রিয়া কাশ্মীরের বাস্তুচ্যুত ভোটারদের পক্ষে সাহসী এবং ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দুর্দান্ত প্রজ্ঞা এবং সাহসের পরিচয় দিয়েছে। দেরিতে হলেও এটি সত্যিই একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ যা ভবিষ্যতে আরও সংস্কারের জন্য নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়। আশা করা যায় যে, ভারতের নির্বাচন কমিশনও আগামী দিনে আইন, বিধি এবং প্রবিধানের এই সংস্কারমূলক প্রয়োগ দ্বারা পরিচালিত হবে। সর্বোপরি, আইন এবং নিয়ম সমাজের উন্নতির জন্য এবং জনগণের কল্যাণের পথে বাধা হয়ে যেন না দাঁড়ায়।
জম্মু ও কাশ্মীরের জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক সত্য হচ্ছে গত সাত দশকের ইতিহাসে আইন, সাংবিধানিক নিয়ম এবং বিধি-বিধানের ব্যাখ্যা। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৭ সালপর্যন্ত পূর্ববর্তী রাজ্য গণপরিষদ কর্তৃক জম্মু ও কাশ্মীরের সংবিধান প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত “ডিক্রি দ্বারা শাসন” ছিল শাসনের মূলনীতি। দুঃখজনকভাবে এটি অত্যন্ত নেতিবাচক অগ্রাধিকার ছিল যা ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি গৃহীত ভারতের সংবিধানের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রের তৎকালীন সরকার দ্বারা সমর্থিত হয়েছিল। গোড়ায় গলদের দীর্ঘ প্রভাবের সবচেয়ে খারাপ উদাহরণ এটি।
এই যুক্তিতে কোন সন্দেহ নেই যে, পূর্ববর্তী জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের বিশৃঙ্খলা মূলত কাশ্মীরকেন্দ্রিক আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলির দ্বারা সৃষ্ট কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এবং কংগ্রেসের ভূমিকাও এতে নেহায়েত কম নয়। শাসকগোষ্ঠীর ‘কল্যাণ’ এবং সামগ্রিকভাবে রাজ্যের ক্ষতির জন্য এই দু’পক্ষই তাদের সর্বোচ্চ অবদান রেখেছিলেন। এখানে এমন একজন শক্তিশালী নৈতিক এবং সাহসী চরিত্রের প্রয়োজন ছিল যিনি ঘটনা প্রবাহ পরিবর্তন করে দেবেন, যার জন্য পরবর্তী নির্বাচন গুরুত্বের বিষয় হবে না, একজন নেতা যিনি দিনের পর দিন বিরোধিতা এবং সমালোচনা সত্ত্বেও ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করতে যে কোনো দূর যাবেন এবং মানুষের কল্যাণ যাঁর মন-মস্তিষ্কের গভীরে রয়েছে। মোদী এবং শাহের জুটি তাঁদের দৃঢ়়তা, উদ্যোগ এবং দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে এটি সম্ভব করেছে যা ভবিষ্যতে পরিবর্তন করা প্রায় অসম্ভব। যে কোন রাজনৈতিক জোটই এখন কেন্দ্রশাসিত জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের কাছ থেকে সংবিধান ও গণতন্ত্রের এই অমূল্য উপহার কেড়ে নেওয়ার সাহস করতে পারে না।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণের জন্য স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং দায়বদ্ধতার বিষয়গুলি উত্থাপন করার সময় এসে গেছে এখন। সাধারণ মানুষের জানার অধিকার আছে যে তাদের অর্থ ও ক্ষমতার কী প্রয়োগ করা হচ্ছে যার দায়িত্ব তারা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতাদের কাছে দিয়েছে। পঞ্চায়েত, ব্লক এবং জেলা উন্নয়ন পরিষদের নির্বাচিত নেতাদের ওপর কেবল তাদের অঞ্চলের ভৌগোলিক চিত্রই নয়, তাদের প্রচেষ্টার ফলাফল সম্পর্কিত রাজনৈতিক ডিসকোর্স এবং সামাজিক আখ্যানের চরিত্রও পরিবর্তন করার একটি মহান দায়িত্ব রয়েছে। ক্ষমতা, প্রভাব এবং তহবিল ব্যবহারের তৃণমূল স্তরের কর্তৃত্ব দিয়ে তাদের নির্বাচনী এলাকা, গ্রাম, ব্লক এবং জেলায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। মহারাষ্ট্র এবং গুজরাটের মতো একটি প্রাণবন্ত তিন-স্তরের আদর্শ পঞ্চায়েতি শাসন ব্যবস্থা পেতে তাদের এই বিষয়ে শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।
এটি কেন্দ্রশাসিত জম্মু ও কাশ্মীরে গণতন্ত্রের একটি নতুন সকাল, এবং এখানকার জনগণই প্রথম সুযোগেই একে সফল করার জন্য পূর্ণ প্রশংসার দাবিদার।