সেলিম হায়দার : “জীবে প্রেম করে যেই জন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর” স্বামী বিবেকানন্দ-এর এই বাণী প্রতিফলিত হয়েছে রাশেদ বিশ্বাস নামের সাদা মনের একজন মানুষের মাঝে। সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার আগোলঝাড়া গ্রামের মধ্যবিত্ত এক কৃষক পরিবারে জন্ম তার। পেশায় বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক। প্রকৃতি ও পাখিকে তো ভালোবাসে সবাই। কিন্তু পাখির প্রতি ভালোবাসার প্রকাশের ধরণটা একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম। কেউ বাসার খাঁচায়় পাখি পুষতে ভালোবাসেন, আবার কেউ খাঁচার পাখিকে মুক্ত করে দিয়ে আনন্দ পান। অনেকে তার ভালোবাসার মানুষটিকে আদর করে পাখি সম্বোধন করেন। রাশেদ তেমনি এক পাখি প্রেমী মানুষ। শুধু পাখি প্রেমী বললে ভুল হবে, তাঁর মুখের কথায় ঝরে পড়ে প্রকৃতির জয়গান। মানুষের আশা কখনোই বিফলে যায় না তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাশেদ।
রাশেদ ২০০৭ সালে খুলনা সরকারি বি,এল কলেজে ইংরেজী বিভাগে পড়াশুনার পাশাপাশি পাখি ও জীববৈচিত্র নিয়ে কাজ করতে শুরু করে। এলাকায় যারা ফাঁদ পেতে কিংবা ইয়ার গানের মাধ্যমে পাখি শিকার করতো,তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় অভিযোগ করে কিংবা সচেতনতা বৃদ্ধি করে পাখি শিকারীদের ধরিয়ে আনতো সে। এলাকার লোকজন রাশেদের এ কাজকে প্রথমে হেয়ালি করতো। কিন্তু তার পাখির প্রতি মমতা ধীরে ধীরে বিস্তৃতি লাভ করে। কখনো নিজ এলাকায় আবার কখনো ভিন্ন জেলায় নিজের অর্থ খরচ করে যারা পাখি শিকার করে তাদেরকে সচেতন করে বেড়ান তিনি। কখনো আবার স্কুল-কলেজেসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ক্যাম্পেইন করে শিক্ষার্থীদের নিয়ে সচেতনতামুলক অনুষ্ঠান করেন। পাখি শিকারীদের সামনে পেলেই তিনি বাঁধা দেয়ার পাশাপাশি পাখি শিকার না করার জন্য সচেতন করেন। আবার এলাকাবাসীকে পাখি শিকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস যোগান। তাঁর এ কাজকে অভিনন্দন জানিয়ে বাংলাদেশ পাখি ও বন্যপ্রাণী বিশ্লেষক শরিফ খান (২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক পরিবেশ পদকপ্রাপ্ত ও বাগেরহাটের ওয়াইল্ড লাইফ ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক) একটা সময় সাড়া দেন। তাকে উৎসাহ প্রদান করেন। এতে তার কাজে বেশ অগ্রগতিও হয়। এলাকায় বন্যপ্রাণী যেমন- বনবিড়াল, সারাল, শিয়াল, খেঁকশিয়াল এদের বাচ্চা অবিবেচক মানুষের শিকার হলে, রাশেদ খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান এবং বাচ্চাগুলোকে রক্ষার জন্য কাজ করেন। বন্যপ্রাণী রক্ষায় মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে অবিবেচক মানুষদের থামাতে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করেন তিনি। এজন্য অনেকের রোষানলে পড়তে হয়েছে তাকে।
এমন ব্যতিক্রমী কাজে কেন তিনি উদ্বুদ্ধ হলেন এ প্রশ্নের জবাবে রাশেদ বিশ্বাস বলেন, তিনি পাখি, প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী ভালবাসেন। পাখি যখন আকাশে উড়ে বেড়ায় তখন তাঁর খুব ভাল লাগে। মানুষের মত সব প্রাণীর বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এজন্য পাখি নিয়ে কাজ করেন তিনি।
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় তাঁর পরিকল্পনা সুদূরপ্রসারী জানিয়ে তিনি আরো বলেন, পরিবেশ, প্রকৃতি, জলবায়ুর ভারসাম্য ঠিক রাখতে হলে প্রকৃতির প্রাণ জীববৈচিত্র্য পাখি-বন্যপ্রাণী এদেরকে টিকিয়ে রাখতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এদের ভুমিকা অনস্বীকার্য। প্রকৃতি বাঁচলে মানুষও বাঁচবে। অদূর ভবিষ্যতে তিনি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সহযোগিতা পেলে পাখি শিকারী ও বন্যপ্রাণী নিধনকারীদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে চান তিনি।
এদিকে রাশেদের এ প্রকৃতি প্রেমের গল্প ফেসবুকের মাধ্যমে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশ পর্যন্ত পৌঁছায়। সেখানকার প্রকৃতিপ্রেমী একব্যক্তি তার কাজে খুশি হয়ে তাকে উৎসাহ প্রদানের পাশাপাশি উপহারও পাঠান। বিদেশীদের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে তার কাজের উদ্দীপনা দ্বিগুণ বেড়েছে।
আলোর বাইরে নিভৃত প্রকৃতির সেবায় নিয়োজিত রাশেদের মত মানুষদের উপর নেই সমাজের লাইট কিংবা ক্যামেরার ফোকাস। তবুও আপন মনে মানব সেবায় নিয়োজিত হয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। দেশের প্রতিটি এলাকায় প্রকৃতি প্রেমি এমন রাশেদ বিশ্বাস তৈরি হোক এমন প্রত্যাশা সকলের।