কামরুল হোসেন মনি, খুলনা : খুলনাঞ্চলে থার্টি ফাস্ট নাইট উপলক্ষে মাদক চোরাচালান ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অঞ্চল দিয়ে ভারতীয় সীমান্ত রুটগুলো সহজে যাতায়াত সুবিধা থাকায় প্রতি বছর এ সময় যশোর বেনাপোল সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে ফেনসিডিল, হেরোইন, বিয়ার, মদ ও গাজা।
খুলনার মাদক সম্রাটশাহজাহান বড় দিন ও থার্টি ফাস্ট নাইট উপলক্ষে বিপুল পরিমান বিদেশী অবৈধ মদ ও বিয়ার বিক্রির উদ্দেশ্যে শাহজাহান মজুদ করছিল- এমন তথ্য ছিল র্যাব-৬’র কাছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় র্যাব নগরীতে তার পৃথক আস্তানায় অভিযান চালিয়ে ২৬৩টি বিয়ার ক্যান ও ১৫৭ বোতল দেশী-বিদেশী মদসহ মুলচোরাকারবারী শাহজাহানসহ ৭ জনকে আটক করে। জব্দকৃত মদ ও বিয়ারের মুল্য আনুমানিক ১০ লাখ টাকা। শাহজাহানের সেকেন্ড ইন কমান্ড মনা ও মাদক বহনকৃত ব্যবহৃত গাড়ির চালক আলমগীর পলাতক রয়েছে। শুক্রবার র্যাব-৬ এর কার্যালয় প্রেস বিফিংয়ে এ তথ্য জানানো হয়।
র্যাব-৬ এর স্পেশাল কোম্পানী কমান্ডার মোঃ এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, খুলনার মাদক সম্রাট শাহজাহান ২৫ ডিসেম্বর বড় দিনকে ঘিরে অবৈধ বিদেশী মদ ব্যাপকভাবে বিক্রি করেছে। সে ৩১ ডিসেম্বর থার্টি ফাস্ট নাইটকে কেন্দ্র করে বিপুল পরিমান বিদেশী অবৈধ মদ ও বিয়ার বিক্রির উদ্দেশ্যে মজুদ করছিল। এমন গোপন তথ্যের ভিত্তিে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে নগরীর সোনাডাঙ্গা থানাধীন মজিদ স্মরনী বটতলায় মাদক সম্রাট শাজাহান এর সোনালী এন্টারপ্রাইজ গ্রিল ওয়ার্কশপ এবং এম এ বারি সড়কের দারুল সালাম মহল্লার ২৮/৬ নম্বর বাসায় র্যাব-৬ এর একটি টিম অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশী বিয়ার ২৬৩ ক্যান ও দেশী-বিদেশী ব্র্যান্ডের ১৫৭ বোতল মদ উদ্ধার করা হয়। অভিযানে মাদক স¤্রাট শাহজাহানসহ ৭ জনকে আটক করা হয়।
আটককৃতরা অন্যারা হচ্ছে চুয়াডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা মোঃ আসাদুল বিশ্বাসের পুত্র মোঃ সাগর বিশ্বাস, নগরীর টুটপাড়া এলাকার বাসিন্দা পাকুন জয়ধর এর পুত্র সুশীল জয়ধর, দক্ষিণ বাগমারা এলাকার বাসিন্দা মোঃ নিজাম উদ্দিনের পুত্র মেহেদী হাসান, বাগেরহাট জেলার মোড়লগঞ্জ উপজেলার সোনাখালী এলাকার বাসিন্দা মৃত মজিদ গাজীর পুত্র মোঃ রুস্তুত গাজী, পশ্চিম বানিয়াখামার এলাকার বাসিন্দা শেখ জাহাঙ্গীর কবিরের পুত্র শেখ রাসেল কবির ও দারুল সালাম মহল্লার এলাকার বাসিন্দা বায়তুল ইসলামের স্ত্রী মোসাঃ পপি ইসলাম।
কোম্পানী কমান্ডার এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, উদ্ধারকৃত অবৈধ মদ ও বিয়ার আটক শাহজাহান ঢাকা ও মংলাপোর্ট থেকে তার ব্যবহৃত প্রাইভেট কারে করে চালান এনে মজুদ করতেন। শাহজাহানের সেকেন্ড ইন কমান্ড মনা ওরফে মনো নামে পরিচিত ও মাদকবহন যানবাহন চালক আলমগীর হোসেন পলাতক রয়েছে। তাদের ধরতে র্যাবে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, এর আগেও র্যাবের হাতে শাহজাহানের বিপুল পরিমান মদ ও বিয়ারসহ আটক হন। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে। গ্রেফতারকৃতদেরবিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা দায়ের করার প্রস্তুতি চলছে। এর সাথে পলাতক দুইজনকে আসামি করা হচ্ছে। এর আগে শাহজাহানের মাদককের একাধিক চালানা ধরা পড়লেও সে সব সময় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এবার নিয়ে সে দুই বার আইন শৃঙ্খলার বাহিনীর হাতে আটক হয়।
এদিকে, থার্টি ফাস্ট নাইট উপলক্ষে খুলনাঞ্চলে মাদকের চোরাচালানী সক্রিয় রয়েছে। বিষয়টি মাথায় রেখে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নজরদারী বৃদ্ধি করেছেন। জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় এর উপ-পরিচালক মোঃ রাশেদুজ্জামান এ প্রতিবেদককে বলেন, থার্টি ফাস্ট নাইট উপলক্ষে তাদের টিম দিন-রাতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। মঙ্গলবার যশোর থেকে ১৩০ ফেনসিডিল ঝালকাঠির উদ্দেশ্যে শরীরের বেধে পাচারকালে নগরী রূপসা ট্রাফিক মোড় থেকে দুই মহিলাকে গোয়েন্দা বিভাগ আটক করে। এছাড়া প্রতিদিন কোন না কোন জায়াগায় থেকে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক উদ্ধার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, জনবল ও যানবাহন সংকট থাকার কারণে অনেক সময় অভিযান ব্যাহত হচ্ছে। যানবাহন না থাকার কারণে অভিযানে ব্যাঘাত ঘটছে।
কেএমপি’র গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (এডিসি) এসএম কামরুল ইসলাম বলেন, থার্টি ফাস্ট নাইট উপলক্ষে তাদের গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া সন্দেহজনক এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। মাদক চোরাচালানকারীদের ধরতে তাদের বিশেষ টিম মাঠে সক্রিয় রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সংশ্লিষ্ট জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১৮ আগস্ট নগরীর সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ ও বিয়ার উদ্ধার করে র্যাব। এ সময় মাদক ব্যবসায়ী শাজাহান হাওলাদারের স্ত্রী ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মুন্নি আকতারকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ সময় ওই বাড়ি থেকে বাংলাদেশের কেরু এ্যান্ড কোম্পানি এবং স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের নানা ব্রান্ডের ৪৫৫ বোতল মদ ও ৭৩৬ ক্যান বিয়ার এবং দু’টি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার করা মাদকদ্রব্যের মূল্য ৩৬ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। তবে এ সময়ও শাহজাহানকে পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় নগরীর সোনাডাঙ্গা থানায় মামলা দায়ের করা হয়। এর আগে ২০১৫ সালের ৫ নভেম্বর বেলা ১১টায় নগরীর খুলনা ক্লাব সংলগ্ন পুলিশ লাইনের সামনের সড়ক থেকে ১৮ বোতল মদসহ তাকে আটক করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি। এছাড়া ২০১১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকা থেকে ১৪৫ বোতল বিদেশি মদ ও ৭২ ক্যান বিয়ারসহ খানজাহান আলী (র.) সেতু এলাকা থেকে পুলিশ একটি প্রাইভেটকারসহ শাহজানের দু’জন সহযোগীকে গ্রেফতার করে। একই বছরের ২৭ মার্চ নগরীর ৩ নম্বর মির্জাপুরে শাহজাহানের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৬৪০ বোতল দেশি-বিদেশি মদ, এক হাজার ৬০৮ ক্যান বিয়ার, একটি একনলা বন্দুক ও ৮ রাউন্ড বন্দুকের কার্তুজ ও নগদ ৯০ হাজার ৭৫০ টাকা, একটি বৌদ্ধমূর্তি, একটি স্বর্ণের সাদা পাথর সম্বলিত আংটি, বিভিন্ন মডেলের ৯টি মোবাইল সেট, একছড়া চাবি ও ৮টি ৫শ’ টাকার জাল নোটও উদ্ধার করে পুলিশ। ২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিল পুলিশ নগরীর সিমেট্রি রোডের একটি আবাসিক ভবনে অভিযান চালিয়ে শাহজাহানের ২২ লক্ষাধিক টাকা মূল্যের প্রায় ৫শ’ বোতল দেশি-বিদেশি মদ ও বিয়ার উদ্ধার করা হয়। নগরীর সিমেট্রি রোডে শাহজাহানের ভাড়া বাড়িতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে ২৬৬ ক্যান বিয়ার, ২২১ বোতল দেশি-বিদেশি মদ এবং মদ বিক্রির ১২ হাজার ৮শ’ নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়। তবে পুলিশ সেবারও শাহজাহানকে ধরতে পারেনি। এমনকি এ মামলায় শাহজাহানকে আসামি পর্যন্ত করা হয়নি।