এস এম জামাল, কুষ্টিয়া : খাবারের থালা হাতে ‘আয় আয়’ ডাকতেই রঙ বেরঙের কবুতরগুলো উড়ে এসে জড়ো হলো। মেঝেতে খাবার ছড়িয়ে দিতেই বাক বাকুম করে খাওয়া শুরু করে দিল কবুতরের দল। এ দৃশ্য কুষ্টিয়া শহরের কাস্টম মোড় এলাকার বাসিন্দা গোলাম মোস্তফার বাড়ির কবুতর খামারের। নিতান্ত শখের বশে গড়ে তোলা মোস্তফার খামারে এখন দুর্লভ প্রজাতির প্রায় ৭০০ কবুতরের বাস। যার একেক জোড়ার দাম ৫ হাজার থেকে শুরু করে ২৫ হাজার টাকা। পেশায় হস্তশিল্প সামগ্রী ব্যবসায়ী মোস্তফার অবসর সময় কাটে তার কবুতরদের সঙ্গে। গোলাম মোস্তফা জানান, ছোট বেলা থেকেই তার কবুতর পোষার স্বপ্ন ছিল। ১৯৭৬ সালে কুষ্টিয়া শহরের বাস টার্মিনালের কাছে ভাড়া বাসায় তিনি ১২ জোড়া কবুতর এনে সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপ দেন। তবে ভাড়া বাসায় তেমন জায়গা না থাকায় স্বল্প পরিসরেই চলছিল কবুতর পালন। পরে শহরের কাস্টম মোড়ে নিজস্ব বাড়ি তৈরির পর ছাদের ওপর ঢেউ টিনের ছাউনি দিয়ে প্রায় ২০ বছর আগে তিনি গড়ে তোলেন কবুতর খামার। সেই খামারে সরু রড দিয়ে তৈরি অসংখ্য খোপে এখন নানা জাতের নানা বর্ণের শত শত কবুতরের বসবাস। অনেক খোপে সদ্য তোলা বাচ্চা, আবার কোনো কোনো কবুতর ডিমে তা দিচ্ছে। মোস্তফা বলেন, তার খামারে বেনারশ, চুইথাল, কাগচি, গলাকষা, সবুজগলা, খাঁকিগলা, খইয়ে, শাহানপুরী, কালদোম, মুসলদোম, সবুজছায়াসহ প্রায় ১০৫ প্রজাতির দুস্প্রাপ্য সব কবুতর রয়েছে। তার খামারে বর্তমানে কবুতরের সংখ্যা ৭০০ ছাড়িয়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও তিনি ভারত ও পাকিস্তান থেকে এসব কবুতর সংগ্রহ করেছেন। কখনও কখনও তিনি বিনিময় পদ্ধতিতেও তার সংগ্রহশালা বাড়িয়েছেন। তিনি বলেন, তার এই খামার কোনো বাণিজ্যিক খামার নয়। এখান থেকে তিনি কোনো রোজগারের আশাও করেন না। এটা নিতান্তই তার শখের খামার। তবে তার মতে, কেউ চাইলেই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এমন কবুতরের খামার করতে পারেন। এর মাধ্যমে মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। তার খামারের বাসিন্দা একজোড়া সবুজছায়া কবুতরের বর্তমান বাজার মূল্য ২৫ হাজার টাকা। আর একজোড়া খাঁকিগলা কবুতরের দাম প্রায় ৫ হাজার টাকা। তবে কবুতরের ওড়ার ক্ষমতার ওপর এর দাম নির্ধারণ হয় বলে জানান এ খামারি। এই কবুতরদের খাবারের জন্য গড়ে প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়। খামারের পাশের ঘরেই থরে থরে সাজানো রয়েছে গম, ভুট্টা, ধান, গম ও ভুট্টার ছাল, সরিষা, ডিমের খোষা, ইটের সুরকি, চুনসহ নানা জাতের খাবার। এছাড়া কবুতররা সবুজ সাক-সবজি খেতেও ভালবাসে। এ কারণে মোস্তফা খামারের পাশে ছাদে নানা জাতের গাছপালা ও শাক সবজি চাষ করেছেন। কবুতররা ইচ্ছেমত উড়ে এসব গাছের পাতা খায়। গোলাম মোস্তফা জানান, কবুতরের খুব বেশি রোগ বালাই না হলেও শীতকালে কিছু রোগ দেখা দেয়। এ সময় তিনি স্থানীয় প্রাণী সম্পদ চিকিৎসকের পরামর্শ মত কবুতরদের ক্যালশিয়াম ট্যাবলেট এবং ভিটামিন এ ও ডি জাতীয় ওষুধ পানিতে মিশিয়ে খাইয়ে দেন। তিনি জানান, মাঝে মধ্যে তিনি সব কবুতর খোপ থেকে বের করে উড়িয়ে দেন। ৭০০ কবুতর যখন এক সঙ্গে আকাশে ওড়ে, কেউ কেউ ডিগবাজি দেয় তখন তিনি কবুতর পোষার স্বার্থকতা খুঁজে পান। দৃষ্টিনন্দন এ দৃশ্য দেখে তার প্রাণ ভরে যায়। প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৫টায় উঠে তিনি কবুতর পরিচর্যায় হাত দেন, আর একটানা সকাল ৯টা অবদি চলে এ কাজ। এ কাজে স্ত্রী রেহেনা পারভিন পারুল ও নাতনী হুমাইরা ফারজানা ছোঁয়া তাকে নানাভাবে সাহায্য করে। তিনি বলেন, এই দুজন না থাকলে তিনি একা এই খামার সামলাতে পারতেন না। স্ত্রী রেহেনা পারভিন পারুল জানান, খামারের কবুতরদের মোস্তফা নিজ সন্তানের মতো করে লালন পালন করেন। অনেক খামারি মাংসের জন্য কবুতরের বাচ্চা বিক্রি করলেও তার স্বামী কোনোদিন এমন কাজ করেন না। এই খামার তার ধ্যান-জ্ঞান, অবসরের পুরোটা সময় তার স্বামী এই খামারের কাজে ব্যয় করেন।