- সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে পাথরের ব্যবহার বেড়েছে
- আমদানিকৃত পাথরের বাজার ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার
- চার বছর আগে এই বাজার ছিল ৬০ কোটি টাকার
- লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পাথর আমদানি
- চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হচ্ছে ৩৯ শতাংশ
- স্থলবন্দর দিয়ে আসছে ৬০ শতাংশ
ইউনিক ডেস্ক : ভবন থেকে সড়ক-মহাসড়ক বা বড় প্রকল্পের নির্মাণকাজে তাকালে এখন যে কারও চোখ আটকে যাবে পাথরের বড় স্তূপে। দু-তিন বছর ধরে নির্মাণাধীন অবকাঠামোর পাশে পাথরের স্তূপের এই দৃশ্য অনেকটা চিরচেনা হয়ে গেছে। পাথর নিয়ে এমন দৃশ্যের আড়ালে আছে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা।
পাথরের ব্যবহার এত বেড়েছে যে এখন সিলেটের আটটি কোয়ারি (মহাল) থেকে উত্তোলন করে চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। দিনাজপুরে সরকারি মধ্যপাড়া কঠিন পাথরখনি থেকে উত্তোলিত পাথর আমদানির রাশ টানতে পারছে না। ফলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে আমদানি করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ পাথর। তাতেই পণ্যভিত্তিক আমদানির প্রবৃদ্ধি বা বাজারের আকার হিসেবে পাথর উঠে এসেছে শীর্ষে। সুযোগ তৈরি হয়েছে নতুন ব্যবসার।
আমদানির সরকারি হিসাব ও বাজারদর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মাত্র চার বছরের ব্যবধানে আমদানি করা পাথরের বাজারের আকার ৬০ কোটি থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকায়। এত কম সময়ে কোনো আমদানি পণ্যের বাজার এত দ্রুত বাড়ার নজির খুব কম।
পাথরের বাজার দ্রুত বাড়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইটের খোয়ার চেয়ে পাথরের শক্তি বেশি। ভবন বা স্থাপনা, সড়ক বা মহাসড়কসহ অবকাঠামোর টেকসই নির্মাণে তাই পাথরের চাহিদা বেশি। আবার দেশে এখন ছোট বড় অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে। বড় প্রকল্পেও বিপুল পরিমাণ পাথরের ব্যবহার হচ্ছে।
পাথরের বাজার বাড়ার কারণ নিয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. সেলিম উদ্দিন বলেন, প্রথমত মানুষের সচেতনতার কারণে ইটের খোয়ার বদলে ভবনে পাথরের ব্যবহার বেড়েছে। আবার যেভাবে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, তাতে রড-সিমেন্টের মতো পাথরের ব্যবহার বেড়েছে।
উত্তোলন ও আমদানির চিত্র
চার-পাঁচ বছর আগেও পাথরের প্রধান উৎস ছিল সিলেটের কোয়ারি ও দিনাজপুরের মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি। এই দুই উৎস থেকে বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ টন পাথর সরবরাহ হতো। পাশাপাশি ভারত ও ভুটান থেকে বছরে আমদানি হতো পাঁচ থেকে ছয় লাখ টন।
তবে দেশীয় উৎস থেকে উত্তোলন ব্যাহত হওয়ায় পাথরের সরবরাহ কমে যায়। অন্যদিকে উন্নয়ন প্রকল্পের প্রয়োজনে হু–হু করে বাড়তে থাকে চাহিদা। এই চাহিদার প্রয়োজনে প্রথমে ছয়টি স্থলবন্দর দিয়ে পাথর আমদানি বাড়তে থাকে। ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে শুরু হয় পাথর আমদানি।
দেশে আমদানি পণ্যের তালিকায় এত দিন কোটি টনের বেশি আমদানি হতো শুধু সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল ক্লিংকার। গত অর্থবছর থেকে কোটি টনের ক্লাবে যুক্ত হয়েছে পাথরের নাম। ক্লিংকারের প্রবৃদ্ধি ছাপিয়ে খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে পাথর আমদানির পরিমাণ। যেমন গত অর্থবছর ক্লিংকার আমদানি হয় ১ কোটি ৫৮ লাখ টন। পাথর আমদানি হয় ১ কোটি ২৬ লাখ টন।
জানতে চাইলে প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পাথর আমদানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে সিমেন্টের ক্লিংকার আমদানির পরিমাণকে তা ছাড়িয়ে যাবে। শুধু শহর বা বড় প্রকল্পেই নয়, এখন গ্রামেগঞ্জে ভবন নির্মাণে পাথরের ব্যবহার হচ্ছে।
বিশৃঙ্খল থেকে শৃঙ্খলার পথে
পাথরের ব্যবসা একসময় ছিল সিলেটের পাথর ব্যবসায়ীদের হাতে। চার বছর আগে থেকে চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পর এই খাতে যুক্ত হন নতুন নতুন ব্যবসায়ী। ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক থেকে শিল্পমালিকেরাও নিজেদের কারখানা বা অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজন বা বাণিজ্যের জন্য পাথর আমদানি শুরু করেন। আবার অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ীও বিদেশ থেকে আমদানি করে পাথরবাণিজ্যে ঝুঁকে পড়েন। বন্দর দিয়ে পাথর আমদানির শুরুতে ছিল এমন বিশৃঙ্খলা। বর্তমানে বড় ব্যবসায়ীরা যুক্ত হওয়ায় ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অনেকে সটকে পড়ায় এই খাতে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৭-১৮ পর্যন্ত পাথর আমদানিতে যুক্ত হয়েছে প্রায় ৬০০ প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পাথর আমদানি করেছে ১০০টির মতো প্রতিষ্ঠান।
জানতে চাইলে পাথর আমদানিকারক গ্রিনগ্রেইন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকিল আহমেদ তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, পাথর ব্যবসায় সরবরাহ ব্যবস্থাটা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। বন্দর থেকে খালাস করে প্রকল্প স্থান পর্যন্ত পাথর সরবরাহে এখনো গতিশীল ব্যবস্থা চালু হয়নি।