ফসলের ক্ষেতে বিষের ঝাঁঝে হুমকিতে জীব বৈচিত্র

প্রকাশঃ ২০২৩-০৩-১২ - ১৬:৫৮

কীটনাশকের ব্যাপক প্রয়োগেও মিলছে না প্রতিকার

ইউনিক ডেস্ক : চলতি মৌসুমে খুলনার বিভিন্ন স্থানের বোরো চাষীরা মাজরা পোকার আক্রমনে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। পরিস্থিতি মোকাবেলায় দফায়-দফায় কীটনাশক ব্যবহার করেও নানা স্থানের চাষীরা সুফল পাচ্ছেন না। আগাছা পরিষ্কার করতেও বিষের ব্যবহার বেড়েছে। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে উপকারী পোকা, প্রাণী ও পাখি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। অপরদিকে, বর্গা চাষী ও অল্প জমির মালিক কৃষকেরা বিষের খরচ যোগাতে যেয়ে হাফিয়ে উঠছেন। অর্থাভাবে তারা স্থানীয় কীটনাশক বিক্রেতাদের কাছ থেকে বাকীতে বিষ কিনতে যেয়ে ঠকছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

জেলার নয় উপজেলাসহ নগরীর লবনচরা ও দৌলতপুর থানা এলাকায় এবার ৬২ হাজার ৮শ’ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছিল। এর বিপরিতে ৬৩ হাজার ৭শ’ ৯০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। যা হাইব্রিড ও উফশি জাতের। ক্ষেতে রোপনের পর কোথাও চারার বয়স এক মাস, কোথাও ১৫ দিন অথবা এর সামান্য কম-বেশি। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বিভিন্ন স্থানের চাষীদের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, খুলনায় ৩ লাখ ১৭ হাজার কৃষক পরিবার চাষাবাদের কাজে যুক্ত আছেন। যদিও বর্গাচাষীদের কোনো সংখ্যা খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। জমির মালিককে ফসলের আধা-আধি ভাগের বিনিময়ে বর্গাচাষীরা কৃষিকাজ করেন। কিন্তু বোরো চাষে তাদেরকে পানির জন্য সেচ যন্ত্রের মালিকদেরও একভাগ দিতে হয়। সেক্ষেত্রে ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ তারা পান।

রূপসা উপজেলার আইচগাতী ইউনিয়নের যুগিহাটী গ্রামের রাকিব হোসেন ঢালী (২৩) পুটিমারী বিলে দুই বিঘা জমিতে বোরো ধানের বর্গা চাষ করছেন। চারা রোপনের ১২ দিনের মাথায় তিনি কেঁচো পোকা নিধনের জন্য তরল কীটনাশক ও দ্রুত চারার বাড়ন্ত অবস্থা তৈরিতে ভিটামিন প্রয়োগ করেছিলেন। এরপর দুই সপ্তাহের মধ্যে ক্ষেতে পায়রা পোকার উপস্থিতি দেখে তিনি অংকুর নামেরসহ আরও তিন প্রকার দানাদার বিষ প্রয়োগ করেন। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই জমিতে মাজরা পোকা আক্রমন করে। এরপর তিনি দুই প্রকার কীটনাশক পানির সাথে মিশিয়ে স্প্রে করেছেন। তাতেও মাজরা পোকার আক্রমন রোধ হচ্ছে না। পোকা চারার গোড়ার অংশ কেটে দিচ্ছে, শুকিয়ে মারা যাচ্ছে।

দরিদ্র কৃষক রাকিব স্থানীয় একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বাকীতে কীটনাশক কিনেছিলেন, কথা ছিল-ধান কাটার পর তিনি ফসল দিয়ে দেনা পরিশোধ করবেন। কিন্তু, দফায়-দফায় বিষ প্রয়োগেও পোকার আক্রমন থামানো যাচ্ছে না, এমন কথা তিনি অন্যদের বলার পরই ওই ব্যবসায়ী তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। উত্যপ্ত ও অশ্লীল বাক্য প্রয়োগের এক পর্যায়ে তিনি ভুক্তভোগীকে দ্রুত পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য তাগিদ দিয়েছেন। একদিকে মাজরা পোকার আক্রমন, অন্যদিকে দেনা পরিশোধের তাড়া ওই কৃষকের কপালে দুশ্চিন্তার ভাজ ফেলেছে বলে জানা গেছে।

পুটিমারী বিলে আইচগাতী ইউনিয়নের চার গ্রামের প্রায় ৫শ’ কৃষক বোরো আবাদ করেছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। সেখানকার অন্তত ১০ জন কৃষক সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে মাজরা পোকার আক্রমন এবং বিভিন্ন কীটনাশক ব্যবহারেও সুফল না পাওয়ার কথা বলেছেন।

এই ইউনিয়নের আব্দুলের মোড় এলাকায় একটি দোকানের সামনে বেশ কয়েকটি প্লাস্টিকের পাত্রে বিভিন্ন রকম কীটনাশক রেখে স্বল্পবিত্ত চাষীদের অল্প চাহিদামতো সরবরাহের ব্যবস্থার খবর মিলেছে। প্যাকেট খুলে বিষ বের করে অন্যান্য পাত্রে বিক্রির জন্য সংরক্ষিত একটি ছবি জন্মভূমির বার্তা কক্ষের সংবাদকর্মীদের হাতে এসেছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, খুলনার নয় উপজেলাসহ মেট্রো অঞ্চলে ৫৬ জন পাইকারী কীটনাশক ডিলার রয়েছেন, খুচরা বিক্রেতার সংখ্যা ৮শ’ ৮৬ জন।

বিভিন্ন স্থানের কয়েকজন কৃষক জানান, অর্থকষ্টে থাকা চাষীরা ধান কাটার পর ফসল দিয়ে দেনা পরিশোধের মৌখিক চুক্তিতে  বিক্রেতাদের কাছ থেকে পণ্য কেনেন। এই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা হতদরিদ্র কৃষকদের জিম্মি করে ফেলেন। সার কিনতে গেলে কেউ-কেউ বিভিন্ন কীটনাশক ও ভিটামিন জাতীয় ওষুধ নিতে বাধ্য অথবা প্রলুব্ধ করেন। বিভিন্ন কোম্পানির কীটনাশকে কমিশন সিস্টেম থাকায় ব্যবসায়ীরা নগদ ক্রেতাদের কাছে প্যাকেটে লেখা দামের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম দামে বিষ সরবরাহ করেন। বাকীতে পণ্য কেনা চাষীরা সেই সুযোগ পান না। ধান কাটার পর বাজার দরের তুলনায় মন প্রতি দু’-আ্ড়াইশ’ টাকা কম মূল্যে সার, বীজ ও কীটনাশক ব্যবসায়ীদেরকে তারা ফসল দিয়ে দেনা শোধ করেন।

দাকোপ উপজেলার পানখালী ইউনিয়নের বাড়ুইখালী গ্রামের কৃষক সমীরন রায় (৩৮) এক বিঘে জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। তিনি বলেন, ক্ষেতে চারা রোপনের এক সপ্তাহের মধ্যেই ব্যাপক হারে পায়রা পোকা আক্রমন করে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় দানাদার ও তরল কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়, কিন্তু কিছুদিন পরেই মারাত্মকভাবে মাজরা পোকা হামলে পড়ে। ওই পোকা চারার গোড়া থেকে কেটে দিয়ে পুরো ক্ষেতের ফসল মেরে ফেলেছে। ওই গ্রামের আরও পাঁচ-সাত জন কৃষকের অবস্থাও তার মতোই।

নগরীর খুলনা সদর থানাধীন কালীবাড়ী রোড এলাকায় আটটি সার, বীজ ও কীটনাশক বিক্রির দোকান রয়েছে। সম্প্রতি মাজরা পোকা নিধনে ব্যবহৃত ফিক্স-২, হারকিউলিসসহ বিভিন্ন বীষের চাহিদা বেড়েছে। বিক্রি বেড়েছে- প্যারামক্স নামের এক ধরণের (বন মারা) আগাছা নিধন করা কীটনাশকেরও। সেখানকার ব্যবসায়ীদের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এদিকে, বন মারা কীটনাশক ব্যবহার করায় ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কারে যুক্ত ক্ষেতমজুরদের এখন কাজের চাহিদা এবং মজুরি কমে গেছে। ডুমুরিয়া উপজেলার আটুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা মোঃ সামাদ আলী (৫৫) রূপসা উপজেলার একটি বিলে ক্ষেতমজুরের কাজ করার সময় এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, গেল আমন মৌসুমে ছয় দিনে তিন-সাড়ে তিন হাজার টাকা মজুরি পেলেও এখন পাচ্ছেন ২২শ’ টাকা।

খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, কীটনাশক কোম্পানিগুলো ৭০ এর দশকে বাজারজাত করার উদ্দেশ্যে কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বালাইনাশক বিতরণ করত। এখন ব্যাপক হারে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়ে গেছে। অনেক চাষী পরিমাণগত প্রয়োগের বিষয়টি না বুঝে ক্ষেতে অতিরিক্ত বালাইনাশক ব্যবহার করছে। এতে কেঁচোসহ বিভিন্ন উপকারী পোকা, ব্যাঙ-ব্যাঙাচি ও খাল-বিলের মাছের ক্ষতি হচ্ছে। ওই সব পোকা ও প্রাণী থেয়ে ফিঙে, বকসহ বিভিন্ন পাখির জীবন বিপন্ন হচ্ছে। প্রকৃতিতে জীব বৈচিত্রের ভারসম্য নষ্ট হচ্ছে।

উপজেলা পর্যায়ের একজন কৃষি কর্মকর্তা বলেন, আগে ছিল হলুদ মাজরা, এবার কালো মাথা মাজরা পোকার আক্রমন দেখা দিয়েছে। নতুন জাতের মাজরা দমনে প্রয়োজনীয় কীটনাশক ব্যবহারের পরামর্শের পাশাপাশি ক্ষেতে গাছের ডাল পুতে শিকারী পাখি বসার ব্যবস্থা এবং আলোক ফাঁদের মাধ্যমে প্রকৃতিক উপায়ে পোকা নিধন করা হচ্ছে। যদিও এখন পর্যন্ত মাজরা পোকার আক্রমনে ক্ষয়-ক্ষতির খবর পাওয়া যায় নি বলে খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক দাবি করেছেন।