বাঘাবাড়ী নৌপথে নাব্যতা সঙ্কট অব্যাহত

প্রকাশঃ ২০১৮-০২-১১ - ১৯:৫৫

ফারুক হোসেন, পাবনা : বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের সামনে বড়াল নদীর মাঝে জেগে ওঠা বিশাল চরের পরিধি বাড়ায় দু’টি জাহাজ পাশাপাশি চলতে পাড়ছে না। এদিকে বাঘাবাড়ী বন্দর মূখী যমুনা নৌপথের নাব্যতা সঙ্কট অব্যাহত রয়েছে। ফলে বন্দরে আমদানি রফতানি অর্ধেকৈ নেমে এসেছে। বিপিসি’র বাঘাবাড়ী ডিপো’র পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা ৩টি কোম্পানির বিপনন কেন্দ্রে আপদকালীন মজুত কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র সাড়ে তিন কোটি লিটারে। এই নাব্যতা সঙ্কটের সুযোগে কিছু কিছু অসাধু তেল ব্যবসায়ী ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে ২-৩ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে অভিযোগ উঠেছে, বিআইডাব্লিউটিএ নৌচ্যানেল সচল রাখতে গতানুগতিকভাবে ড্রেজিং করে যাচ্ছে। নাব্যতা বজায় রাখার জন্য তারা কোন বিকল্প পদ্ধতি প্রয়োগ করছে না। স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিআইডাব্লি¬উটিএ’র অপরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের কারণে নাব্যতা সঙ্কট অব্যাহত রয়েছে। তারা ড্রেজিং করে পলিমাটি নিরাপদ দুরুত্বে না ফেলে নদীতেই ফেলছে। ফলে ড্রেজিং স্পয়েল ¯্রােতের টানে ভাটিতে গিয়ে জমে আবারো নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। অপরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের কারণে শুধু টাকার অপচয় হচ্ছে। এতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
যমুনা নদী পাড়ের একাধিক সূত্র জানায়, ২০০৩ সালে বাঘাবাড়ী নৌপথে মারাত্মক নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। সে সময় ড্রেজিংয়ের পাশাপাশি যমুনা নদীর দুই পাশে বিভিন্ন পয়েন্টে বাঁশের বাঁধ নির্মাণ (বান্ডালিং পদ্ধতি) করে তাতে তালাই বিছিয়ে নদীর প্রশস্ততা কমিয়ে আনা হয়। প্রশস্ততা কমে যাওয়ায় পানি নদীর মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে পানির প্রবাহ ও স্্েরাতে গতি বেড়ে যায়। ফলে নদীতে পলি জমতে পারে না। পানির উচ্চতা ও প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় নাব্যতা ফিরে আসে। বর্তমানে ড্রেজিয়ের পাশাপাশি অল্প খরচে বান্ডালিং পদ্ধতি প্রয়োগ করে নদীতে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে সূত্র জানিয়েছে।
রাজশাহী ও রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মওসুমে উত্তরের ১৬ জেলায় প্রায় ১৭ লাখ ৯২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্র নির্ধারন করা হয়েছে। এ অঞ্চলে বোরো ধানের চারা রোপণ পুরোদমে শুরু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বোরো ধান চাষ করে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, চাপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, নাটোর, নওগাঁ, জয়পুরহাট ও রাজশাহী জেলার কৃষক। পাবনা জেলায় ৭৩ হাজার ১৪৭ হেক্টর, সিরাজগঞ্জে এক লাখ ৩৭ হাজার ৬৭ হেক্টর, বগুড়ায় এক লাখ ৯৮ হাজার ২৫৮ হেক্টর, জয়পুরহাটে ৭৬ হাজার ৫০৫ হেক্টর, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৫৬ হাজার ৩৮১ হেক্টর, নওগাঁয়ে দুই লাখ ১৯৬ হেক্ট, রাজশাহীতে ৮৪ হাজার ৭০০ হেক্টর, পঞ্চগড়ে ৫১ হাজার ৫৩৫ হেক্টর, ঠাকুরগাঁওয়ে ৭১ হাজার ১৮৩ হেক্টর, দিনাজপুরে এক লাখ ৮৫ হাজার ৫৪৫ হেক্টর, নীফামারীতে ৮৬ হাজার ৮৭৮ হেক্টর, লালমনিরহাটে ৬১ হাজার ৯৯ হেক্টর, কুড়িগ্রামে এক লাখ ১৭ হাজার ২৭৭ হেক্টর, গাইবান্ধায় এক লাখ ২৬ হাজার ৩২৩ হেক্টর, রংপুরে এক লাখ ৪৭ হাজার ৭০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিপিসি’র বাঘাবাড়ী রিভারাইন অয়েল ডিপো ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বোরো মওসুমে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় সেচের জন্য সাত লাখ ৯৬ হাজার ৭৫টি সেচযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। এরমধ্যে ৭০ শতাংশ ডিজেল ও ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎনির্ভর। সেচ মওসুমে ডিজেলচালিত ৮২৮টি গভীর নলকুপ, পাঁচ লাখ ৭৩ হাজার ৮৭০টি অগভীর নলকুপ, ১১ হাজার ৩৭৭টি শক্তিচালিত পাম্পের সাহায্যে সেচ কার্যক্রম চলবে। এর জন্য প্রায় ৫৫ কোটি লিটার ডিজেলের প্রয়োজন হবে। ডিজেল চাহিদার প্রায় ৯০ ভাগ বাঘাবাড়ী রিভারাইন অয়েল ডিপো থেকে সরবরাহ করা হয়। জ্বালানী তেলনির্ভর বেড়ার ৭১ মেঘাওয়াট, বাঘাবাড়ীর ৫০ মেঘাওয়াট, রাজশাহীর আমনুরা ৫০ মেঘাওয়াটসহ ৫টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে। বিদ্যুৎচালিত সেচপাম্পের রয়েছে দুই লাখ ১০ হাজার। এর জন্য বাড়তি বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে প্রায় ৮৪৩ মেগাওয়াট। উত্তরাঞ্চলে জ্বালানী তেল সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার না গেলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। সেই সাথে এ অঞ্চলের সেচনির্ভর বোরো আবাদ ও উৎপাদনে চরম বিপর্যয় নেমে আসবে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাত এই নৌ-পথ নিয়ে সরকারকে ¯œায়ুচাপে থাকতে হয়।
এদিকে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীতে অবস্থিত ২৬৬ মেঘাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন ৪টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। গ্যাস সঙ্কট, যান্ত্রিক ক্রটি ও ওভারহোলিংয়ের কারণে যাত্রিক ক্রটির কারণে পিডিপি,র ১০০ ও ৭১ মেগাওয়াট এবং ওয়েস্টমন্ট পাওয়ার কোম্পানির ৯০ মেগাওয়াটের বিজয়ের আলো-১ ও বিজয়ের আলো-২ দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। বাঘাবাড়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রের ম্যানেজার মোঃ ইবনুল হোসেন জানান, যান্ত্রিক ক্রটির কারণে ১০০ মেগাওয়াট প্লান্টটি খুব সহসা চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।
বগুড়া ন্যাশনাল লোড ডিসপ্যাচ সার্কেল (এনএলডিসি) সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে রাজশাহী বিভাগে প্রতিদিন ৮৮০ মেগাওয়াট ও রংপুর বিভাগে ৫২৭ মেগাওয়াট লোড ব্যবহার করা হচ্ছে। সেচ মওসুমে রাজশাহী বিভাগে প্রতিদিন এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াট এবং রংপুর বিভাগে ৯৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে। বোরোর ভরা মওসুম শুরুর আগেই বাঘাবাড়ী বিদ্যুৎ প্লান্টগুলো উৎপাদনে যেতে না পারলে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় লোডশেডিং প্রকট আকার ধারণ করবে এবং মারাত্মক সেচ সঙ্কট দেখা দেবে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার ডিষ্ট্রিবিউটর এজেন্ট অ্যান্ড পেট্রোল পাম্প ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ জাকির হোসেন জানান, আরিচা-বাঘাবাড়ী নৌপথে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় জ্বালানী তেল, রাসায়নিক সারসহ অন্যান্য মালামাল পরিবহনের একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মাধ্যম। এ নৌপথে জ্বালানী তেলবাহী ট্যাংকার, রাসায়নিক সার ও বিভিন্ন পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ চলাচল করে। বাঘাবাড়ী বন্দর থেকে উত্তরাঞ্চলে চাহিদার ৯০ ভাগ জ্বলানী তেল ও রাসায়নিক সার সরবরাহ করা হয়। উত্তরাঞ্চলে প্রায় পাঁচ শতাধিক পেট্রোল পাম্প, তিন শতাধিক ডিলার এবং পাঁচটি ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র আছে। এছাড়াও প্রায় তিন লক্ষাধিক বাস, ট্রাকসহ ডিজেল চালিত বিভিন্ন ধরনের যানবাহন রয়েছে। নাব্যতা সঙ্কটে লাইটারেজ করে ৩-৪ লাখ লিটার জ্বালানী তেল নিয়ে জাহাজ বাঘাবাড়ী বন্দরে আসছে। লাইটারেজ জাহাজ সঙ্কটের কারণে জ্বালানী তেল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে যমুনা কোম্পানিতে এই সঙ্কট রয়েছে। তিনটি কোম্পানিতে প্রতিদিন রিসিভ হচ্ছে মাত্র ২৩ থেকে ২৫ লাখ লিটার জ্বালানী তেল। প্রতিদিনের ঘাটতি প্রায় ১২ লাখ লিটার আপদকালীন মজুদ থেকে পুরণ করা হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী মার্চ মাসের মাঝামাঝি উত্তরাঞ্চলে জ্বালানী সঙ্কট দেখা দিবে বলে আশংকা । এতে সেচনির্ভর বোরো আবাদ এবং বিদু্যুৎ উৎপাদনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বিআইডাব্লি¬উটিএ আরিচা অফিসের যুগ্ন পরিচালক মোঃ আব্দুস ছালাম জানান, আরিচা-বাঘাবাড়ী নৌপথের কিছু কিছু পয়েন্টে পানির গভীরতা কমে ৫ থেকে ৬ ফুটে দাঁড়িয়েছে। পদ্মা ও যমুনা নদীতে প্রতিদিন পানি কমছে। উত্তরাঞ্চলে জ্বালানীতেল ও রাসায়নিক সার সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য বিআইডাব্লিউটিএ কাজ করে যাচ্ছে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাত এই নৌ-চ্যানেল সচল রাখার জন্য বিভিন্ন পয়েন্টে দু’টি ড্রেজার পলি অপসারন করছে। এদিকে বালির প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় ড্রেজিং করার পর ভাটিতে পলি জমে ডুবোচরগুলো আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে।
বিপিসি’র বাঘাবাড়ী রিভারাইন অয়েল ডিপোর যমুনা কোম্পানির ম্যানেজার এ, কে, এম জাহিদ সরোয়ার জানান, বাঘাবাড়ীতে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তিনটি তেল কোম্পানির ডিপোতে ৩ কোটি ৫০ লাখ লিটার ডিজেল মজুদ আছে। নাব্যতা সঙ্কটে বাঘাবাড়ী বন্দরের ভাটিতে আরিচা থেকে লাইটারেজ করে জাহাজ জ্বালানী তেল নিয়ে বাঘাবাড়ী বন্দরে আসছে। তিনটি কোম্পানিতে গড়ে প্রতিদিন ২৩ থেকে ২৫ লাখ লিটার জ্বালানী তেল রিসিভ হচ্ছে। গড়ে প্রতিদিন সরবরাহ করা হচ্ছে ৩৬ লাখ লিটার। প্রতিদিনের ঘাটতি আপদকালীন মজুদ থেকে পুরণ করা হচ্ছে। এদিকে পদ্মা ও মেঘনা কোম্পানির লাইটারেজ জাহাজ বেশি থাকায় দু’টি কোম্পানির মজুত বেড়েছে। লাইটারেজ জাহাজ সঙ্কটে যমুনা কোম্পানিতে জ্বালানী তেল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন।