বাড়ছে বইয়ের দাম, বইমেলায় ব্যবসা নিয়ে চিন্তিত প্রকাশকরা

প্রকাশঃ ২০২৩-০১-২৯ - ১২:৫৫

ইউনিক ডেস্ক : বছর ঘুরে আবারও আসছে বাঙালির প্রাণের মেলা ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। কিন্তু অন্যান্যবারের চেয়ে এবারের মেলা নিয়ে চিন্তায় আছে সব মহল। লেখক, পাঠক আর প্রকাশকদের এই মিলনমেলায় সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কাগজের উচ্চমূল্য। এ কারণে বাড়ছে বইয়ের দামও। ফলে বইমেলা এলেও বিক্রিবাট্টা নিয়ে সন্দিহান প্রকাশকরা।

তারা বলছেন, সারাবছর বইমেলার অপেক্ষায় থাকেন প্রকাশক ও লেখকরা। ব্যবসা ছাড়াও অনেকটা বইয়ের প্রতি ভালোবাসা থেকেই বই প্রকাশ করেন তারা। তবে কাগজের উচ্চমূল্যে এবার কপালে ভাঁজ পড়েছে তাদের। যার প্রভাব পড়ছে বইয়ের উপরেও, গতবছরের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ছে বইয়ের দাম। এমন দাম বৃদ্ধিতে পাঠক বই কেনার বিষয়ে কতটা আগ্রহী হবে তা নিয়ে সন্দিহান তারা।

অবসর প্রকাশনীর প্রকাশক ফজলুর রহমান আলমগীর বলেন, ‘কাগজের দাম বেড়েছে, তার ওপর চাহিদা অনুযায়ী কাগজও পাওয়া যাচ্ছে না। কাগজের দাম প্রকাশকদের অস্তিত্বে নাড়া দিছে। বইতো আর চাল-ডালের মতো না, যে কিনতেই হবে। সংসারের সব খরচ মিটিয়ে যা উদ্বৃত্ত থাকে, সেটা দিয়ে মানুষ বই কেনে। সেখানে বইয়ের দাম বেশি হলে, মানুষ বই কিনবে কীভাবে? আমার মনে হয় না এবারের বইমেলার অবস্থা ভালো হবে। আশা করেছিলাম, কাগজের দাম কমবে, তবে তেমন কোনও লক্ষণ দেখছি না।’

অধিকাংশ প্রকাশনা সংস্থায় কমিয়েছে নতুন বইয়ের সংখ্যা, প্রতিষ্ঠানভেদে যা ২০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত। তবে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন নতুন প্রকাশনা সংস্থাগুলো। কবিতা প্রকাশনীর প্রকাশক নজরুল হায়দার বলেন, ‘কাগজের দাম বেশি থাকায় এবছর নতুন বই আসছে ১৫-২০টা, আর পুরাতন প্রকাশনা থাকছে ৩০-৪০টি। যেখানে গতবছর ৪৫টা নতুন বই প্রকাশ করেছিলাম। কাগজের জন্য বই ছাপাতে আমাদের বিশাল সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। বিশেষ করে আমরা যারা নতুন প্রকাশক, আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জের। আগে যে বইটা করতে ১৮-২০ হাজার টাকা খরচ হতো, সেখানে এখন খরচ হচ্ছে ৩০-৩৫ হাজার টাকা, কাগজের দাম বেশি, প্লেটের দাম বেশি। বইয়ের দাম বাড়বে স্বাভাবিক, আমাদের বই ফরমা প্রতি ২০ টাকা বাড়বে, অন্যরা কী করবেন জানি না।’

গতবছর বইমেলায় ৬০টি বই প্রকাশ করেছিলেন নালন্দা প্রকাশনীর প্রকাশক জুয়েল আহমেদ। কাগজের দাম বাড়ায় সেই সংখ্যা এবার কমাতে হচ্ছে এই প্রকাশককে। তিনি বলেন, ‘কাগজের যে দাম, বেশি বই প্রকাশ করার সুযোগ এবার নেই। গতবছরের তুলনায় ৪০ শতাংশ প্রোডাকশন খরচ বেড়েছে। বইয়ের দামও ৪০ শতাংশ বাড়বে। এত টাকা দিয়ে পাঠক বই কিনবে না, যে যাই বলুক; এটাই পরিষ্কার কথা বই বিক্রি হবে না। যাদের বই না ছাপলেই নয়, তাদেরই বইই ছাপা হচ্ছে। তবে এবার আমরা চার জন নতুন লেখককে সুযোগ দিচ্ছি। ইন্ডাস্ট্রির জন্য, বাংলা সাহিত্যের জন্য ঝুঁকি নিতেই হবে, নতুনদেরও সুযোগ দিতে হবে।’

দাম বাড়ার পাশাপাশি কাগজ চাহিদা অনুযায়ী পাওয়াও যাচ্ছে না। কাগজের এই চড়া মূল্যের পেছনে সিন্ডিকেটের হাত থাকতে পারে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। সূচিপত্র প্রকাশনীর প্রকাশক সাঈদ বারী বলেন, ‘গতকালের অভিজ্ঞতার কথা বলি, কাগজ কিনতে গিয়ে কাগজই পাইনি। আমরা ৮০ গ্রাম কাগজটা কিনি, কাল টাকা নিয়ে ঘুরেছি, কাগজ পাইনি। কাগজের দামের কারণে স্বাভাবিকভাবে বইয়ের দাম বাড়বেই। আরেকটা বিষয় হবে, যে বইটা ৮০ গ্রামের কাগজ দিয়ে করা হতো সেখানে ৭০ গ্রামের কাগজ দিয়ে বই প্রকাশ করতে হবে। সবকিছুরই দাম বেড়েছে, তবে কাগজের দাম অতিরিক্ত বেড়ে গেছে। এটার পেছনে সিন্ডিকেটের হাত আছে কি না জানি না। জানুয়ারি মাসের এই সময়টাতে কাগজের চাহিদা থাকে। প্রকাশনার বই ছাড়াও কাগজের  চাহিদা থাকে, সিন্ডিকেশন হতেই পারে এটা মিডিয়া, সরকার বের করবে কি হচ্ছে, কাগজের দাম এতটা বাড়া উচিত কি না, প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ‘

তবে সবকিছু ছাপিয়ে পাঠকের দিকেই চেয়ে আছেন অনেক প্রকাশক। তাদের আশা, দাম যেমনই হোক পাঠক যেন বই কেনেন। কবিতা প্রকাশনীর প্রকাশক নজরুল হায়দার বলেন, ‘দাম বাড়লে মানুষ বই কিনবে না এমন না। কারণ পড়ার জন্য বই কতজন কেনে, অধিকাংশই এখন বই কেনেন শখের বশে। তবে পাঠকের সচেতনতার ওপরই নির্ভর করছে এবারের বইমেলা।’

সূচিপত্র প্রকাশনীর প্রকাশক সাঈদ বারী বলেন, ‘বইয়ের দাম বৃদ্ধি নিয়ে আমাদের মধ্যেও হতাশা কাজ করছে। অন্য ব্যবসা মানুষ রুটি-রুজির জন্য করেন, তবে প্রকাশনা ব্যবসাটা আমরা প্রাণের টানে, মনের টানে করি। এই পেশায় বিজনেসটা মুখ্য না। আমরা চেষ্টা করছি সংকট থাকলেও পাঠকের হাতে পৌঁছে দিতে, আশা করছি দাম বাড়লেও পাঠক এটা বুঝবেন, সহজভাবে নেবেন।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আরিফুর রহমান ছোটন বলেন, ‘আমরা অনুরোধ জানিয়েছিলাম জানুয়ারি মাসটা কাগজ শুল্কমুক্ত রাখার জন্য, যাতে বইমেলার সময়টা কাগজের দামটা স্বাভাবিক থাকে, কিন্তু সেটাতে আমরা সাড়া পাইনি। কাগজের চড়া মূল্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা প্রকাশকরা। পাঠকের একটা নির্দিষ্ট বাজেট থাকে বই কেনার জন্য, যেখানে আগে ৭-১০টা বই কিনতো, এবার হয়তো তিন থেকে চারটা কিনবে।’