বেনাপোল : দেশের বৃহত্তর বেনাপোল স্থলবন্দরের অধিকাংশ ক্রেন ও ফর্কলিফট অকেজো হওয়ায় স্থবির হয়ে পড়েছে মালামাল খালাস প্রক্রিয়া। আমদানিকারকরা বন্দর থেকে সময়মতো তাদের পণ্য খালাস করতে পারছেন না। ফলে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ পণ্যজট। বন্দরের গুদাম থেকে পণ্য বের করার পর নতুন পণ্য ঢোকাতে হচ্ছে। জায়গার এ সংকটের কারণে পণ্যবোঝাই ট্রাক বন্দরের অভ্যন্তরে দাঁড়িয়ে থাকছে দিনের পর দিন।
এদিকে ট্রাক থেকে পণ্য নামানোর অনুমতি মিললেও ক্রেন ও ফর্কলিফটগুলো বিকল থাকায় বিপাকে পড়েছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। বন্দর ব্যবহারকারীদের মেশিনারিসহ ভারি মালামাল লোড-আনলোডের সময় পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে সিরিয়াল দিয়ে।
বন্দরের ক্রেন সমস্যার কারণে সোমবার সকালে বন্দরের সামনে বিক্ষোভ করেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। তারা হুমকি দেন আগামী ৫ নভেম্বরের মধ্যে ক্রেন-ফর্কলিফট মেরামত করা না হলে তারা বন্দরের অভ্যন্তরে সকল কার্যক্রম বন্ধ রাখবেন।
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, দেশের সিংহভাগ শিল্প-কলকারখানা, গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ ও বিভিন্ন প্রকল্পের বেশিরভাগ মেশিনারিজ আমদানি করা হচ্ছে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে। ক্রেন ও ফর্কলিফট ছাড়া এ জাতীয় পণ্য বন্দরে আনলোড ও বন্দর থেকে খালাস করা সম্ভব নয়। মংলা বন্দর থেকে ২০০২ সালের ১ ফেব্রুয়ারী স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের পর অতি পুরাতন ক্রেন ও ফর্কলিফট মংলা বন্দর থেকে ভাড়া করে এনে কাজ চালাচ্ছে বেনাপোল বন্দর কর্তৃপক্ষ।
২০১০ সালের ২১ মার্চ বেনাপোল স্থলবন্দরের পণ্য উঠানো-নামানোর জন্য বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঢাকার মহাখালীর মেসার্স এসআইএস (সিস) লজিস্টিক্যাল সিস্টেমের (জেভি) পাঁচ বছর মেয়াদি চুক্তি হয়। ওই বছরের ১ আগস্ট থেকে তারা বেনাপোল স্থলবন্দরে বেসরকারি কার্গো পরিচালনার দায়িত্ব পায়। তারা বন্দরে ৬টি ফর্কলিফট ও ৫টি ক্রেন দিয়ে মালামাল উঠা-নামার কাজ করার পর ওই বছরের ১০ নভেম্বর আরও ৬টি নতুন ফর্কলিফট নিয়ে আসে। কিন্তু, কিছুদিন কাজ করার পর এসব ফর্কলিফট ও ক্রেন অকেজো হতে শুরু করে। তবে দীর্ঘদিনেও তা মেরামতের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
এদিকে, চুক্তি অনুযায়ী ৫টি বিভিন্ন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ক্রেন ও ১১টি ফর্কলিফট দিয়ে পণ্য উঠানো-নামানোর কাজ করার কথা। কিন্তু, দীর্ঘদিন ধরে ৬টি ক্রেন ও ৯টি ফর্কলিফট অকেজো হয়ে পড়ে আছে। বাকি একটি ক্রেন ও ২টি ফর্কলিফট দিয়ে কাজ করা হলেও সেগুলো প্রায় সময় অচল হয়ে পড়ে।
বন্দর সূত্র আরও জানায়, বর্তমানে কাগজে-কলমে এ বন্দরে ২৫-৩০ টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ফর্কলিফট রয়েছে ২টি। এছাড়া ২০ টনের একটি, ১০ টনের একটি, ৫টনের ২টি, ও ৩ টনের ৫টি ফর্কলিফট রয়েছে। অপরদিকে ৪০-৪৫ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্রেন রয়েছে একটি, ৩৫ টনের একটি, ২০-২৫ টনের একটি এবং ১০ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ২টি ক্রেন রয়েছে।
এগুলোর মধ্যে ২টি ফর্কলিফট ও একটি ক্রেণ ছাড়া বাকি সব অকোজো হয়ে পড়ে আছে। বাকিগুলো চলছে আর অকেজো হয়ে পড়ছে। এতে বন্দরে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটছে মালামাল লোড-আনলোডে।
জানা গেছে, ২০১৬ সালে বেনাপোল স্থলবন্দরে বেসরকারি কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে নতুন ঠিকাদার নিয়োগের জন্য দরপত্র আহবান করা হলে, আগের হ্যান্ডলিং ঠিকাদার মেসার্স এসআইএস (সিস) লজিস্টিক্যাল সিস্টেম (জেভি) উচ্চ আদালতে রিট করে। ফলে বন্ধ হয়ে যায় দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়া। এমন পরিস্থিতিতে আগের কোম্পানি তার কাজ চালাচ্ছে জোড়াতালি দিয়ে। যার কারণে এই পথে পণ্য আমদানিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে বন্দর ব্যবহারকারীসহ ব্যবসায়ীরা।
বন্দর ব্যবহারকারী সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চুক্তি অনুযায়ী ইকুইপমেন্ট হ্যান্ডলিং কোম্পানি নতুন কোনো ইকুইপমেন্ট এখানে দেননি। মাঝেমধ্যে মেরামতের জন্য যেসব যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয় তার অধিকাংশই পুরানো। ফলে মাস না ঘুরতেই ফের তা অচল হয়ে পড়ছে।
বন্দরে যেসব ক্রেন ও ফর্কলিফট ব্যবহার করা হচ্ছে তার অধিকাংশই ভাড়া করা এবং অনেক পুরানো। এসব যন্ত্রপাতি দিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ কোনো রকম দায়সারা গোছের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না।
এ ব্যাপারে কথা বললে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বেনাপোল প্রতিনিধি হাফিজুর রহমান জানান, ইঞ্জিনের বিষয়তো, মাঝেমধ্যে সমস্যা হতে পারে। আমরা দ্রুত সব ক্রেন ঠিক করে দিচ্ছি।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক লতা জানান, ৩৮ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার বন্দরে প্রতিদিন ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টন পণ্য উঠানো-নামানো হয়। এতে নুন্যতম সাতটি ক্রেন ও ৩০টি ফর্কলিফট প্রয়োজন। সেখানে একটি ক্রেন ও ২টি ফর্কলিফট দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। ফলে সেগুলো প্রায় সময় বিকল হয়ে পড়ছে। বন্দরের জায়গা ও ক্রেন সমস্যার সমাধান না হলে বন্দরে কার্যক্রম বন্ধ করা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই বলেও জানান তিনি।
বেনাপোল স্থলবন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (ট্রাফিক) আমিনুল ইসলাম বলেন, বারবার তাগিদ দিলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সাড়া দিচ্ছে না। তাছাড়া বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। উচ্চ আদালতে মামলা থাকায় এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি। তবে দ্রুত ইকুইপমেন্ট মেরামত করে বেনাপোল বন্দর সচল রাখার কথা জানান তিনি।