সেলিম হায়দার, তালা : খোলপেটুয়া নদী ও কপোতাক্ষ নদের করালগ্রাসে আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়ন বেড়িবাঁধ ভেঙে দু’বছরে ডুবেছে ৯ বার। এছাড়া ছোটখাটো একাধিকবার ভেঙেছে যা স্থানীয়ভাবে মেরামত করা হয়েছে। এতে সরকারি হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ৩ হাজার ৭শ ৭০টি।
নদীশাসন না করে পাকিস্তানি আমলের নকশা দিয়ে বাঁধ নির্মান করা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সীমাহিন দুর্নীতি, অবহেলা, সময়োপযোগী তড়িৎ পদক্ষেপ না নেয়া, স্থানীয় প্রশাসনের দুর্বলতা,স্থবিরতার কারনে প্রতিবছর লোনাপানিতে ডুবতে হচ্ছে বলে অভিযোগ ইউনিয়নবাসীর। এরমধ্যে আইলার ছোবলে গৃহহারা ৫’শ পরিবার এখনো বসতবাড়িতে ফিরতে পারেনি। তারা সুভদ্রাকাটি বেড়িবাঁধের উপর টোঙ বেঁধে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। প্রত্যেক বছর প্লাবনে হাজার হাজার মানুষ সর্বশান্ত হতে থাকলেও স্থায়ী সমাধানের কোন ব্যবস্থা নেয়নি পানি উন্নয়ন বোর্ড।
বানভাসি লোকজন মনে করেন, পাউবো’র ৭/২ পোল্ডারের নদী ভাঙনই এ ইউনিয়নের প্রধান সমস্যা। এই নদী ভাঙনই এলাকার আয় ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা। প্রতিবছর ভাঙনে ৩৩.৮৯ বর্গ কিঃমিঃ আয়তনের এ ইউনিয়নটির ভৌগলিক পরিবর্তন ঘটছে। বারবার বাঁধ ভেঙে পানিবন্দি হয়ে ইউনিয়নের কাঁচা রাস্তা, ইটের সোলিং, ফ্লাট সোলিং ও পিচের রাস্তা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ছোট ছোট ইটের সোলিংগুলি ও কাঁচা রাস্তা গুলো চলাচলের অনুপোযোগি হয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক কালে দু’বছরে ৯ দফায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ৩ হাজার ৭শ ৭০। এরমধ্যে সরকারি ভাবে ৭ জনকে ৭ হাজার করে টাকা ও ২ বান করে ঢেউটিন প্রদান করা হয়।
গতবছর উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের তথ্যমতে, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ২ ও ৩ তারিখে ইউনিয়নের চাকলা, সুভদ্রাকাটি, শ্রীপুর, দীঘলারআইট গ্রামের বেড়িবাঁধ ভেঙে ১৪০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই মাসের ২০ তারিখে আবারো প্রতাপনগর, হরিশখালী ও চাকলা গ্রামের বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। এ প্লাবনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১০০ পরিবার। ঐ বছর ১৫ অক্টোবর কোলা, হরিশখালী ও শ্রীপুর আবারো ভেঙে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৫০ পরিবার। এই ১৫০ পরিবারের মধ্যে সরকারি ভাবে ৭ জনকে ৭ হাজার করে টাকা ও ২ বান করে ঢেউটিন প্রদান করা হয়। গতবছর প্রথমে ৩০ মার্চ চাকলা গ্রামের বেড়িবাঁধ ভেঙে ২৪০ পরিবার পানিবন্দি হয়। এরপর ১৫ মে আবার চাকলা গ্রামের বাঁধ ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩৫০টি পরিবার। ২৯ মে চাকলা, দীঘলারআইট ও শ্রীপুর গ্রামের বাঁধ আবারো ভেঙে যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কমপক্ষে ১০০ পরিবার। ৮ সেপ্টেম্বর মাদারবাড়িয়া, প্রতাপনগর, দরগাহতলারআইট ও বন্যতলা গ্রামের বাঁধ ভেঙে ১৫০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঠিক একমাস পরে অক্টোবর মাসের ৮ তারিখে আবারো মাদারবাড়িয়া, প্রতাপনগর, দরগাহতলারআইট, চাকলা, কোলা, হিজলিয়া, হরিশখালী ও বন্যতলা এই ৮ গ্রামের বাঁধ ভেঙে আবারো প্লাবিত হয় ৪,৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডের গ্রামগুলি। সরকারি হিসাবমতে এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১১৮০টি পরিবার। এরমধ্যে ছোট খাটো ভাঙনের হিসাব নেই, যেটা পরিষদের পক্ষ থেকে মেরামত করা হয়েছে। শীতকাল ব্যতিত বছরের অন্যান্য সময় নদীভাঙনের ফলে উদ্বেগ, উৎকন্ঠায় কাটাতে হয় ২৯হাজার ২৫০ জন ইউনিয়নবাসীকে।
সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান চাকলা রজব ঢালীর বাড়ি থেকে চাকলা ফিরোজ ঢালীর বাড়ি পর্যন্ত ৮০ চেইন, একই গ্রামের ফিরোজ ঢালীর বাড়ি থেকে শাহজাহান সরদারের বাড়ি পর্যন্ত ৪০ চেইন, সুভদ্রাকাটি সোহরাবের ঘের থেকে একই গ্রামের সাঈদের বাড়ি পর্যন্ত ৬০ চেইন, শ্রীপুর গ্রামের রুহুল বারির বাড়ি থেকে একই গ্রামের আজগরের বাড়ি পর্যন্ত ৬৫ চেইন, পূর্বনাকনা স’মিল থেকে সনাতনকাটি গ্রাম পর্যন্ত ৫০ চেইন ও হিজলীয়া বাস ষ্ট্যান্ড থেকে কোলাগামী ওয়াপদা রাস্তা ২০ চেইন মোট ৩১৫ চেইন ঝুঁকিপুর্ন ওয়াপদা রাস্তা জরুরী ভিত্তিতে সংস্কার ও নির্মানের জন্য ১০ মে’১৬ তারিখে জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত আবেদনে করেন। কিন্তু দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি তো হয়নি বরঞ্চ গত বছরও উপরোক্ত তারিখে ৫ বার বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
পর্যাবেক্ষনে দেখে গেছে, ভাঙন এলাকার মানুষ দুর্যোগকে মোকাবেলা করতে শিখেছেন। আইলার পর থেকে তারা যে কোন নদীভাঙনে বাঁধ মেরামত করতে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ। অদম্য সাহস ও মানসিকতা নিয়ে হাজার হাজার মানুষকে ঝাপিয়ে পড়তে দেখা যায় বাঁধ রক্ষা করতে। বর্ষা মৌসুমে ভাঙবে জেনেও এলাকার প্রধান আয়ের উৎস মাছচাষ করতে তারা এখন মৎস্যখামার রেডি করছেন। বছরে ৪/৫বার ভেসে যায়, তারপরেও তারা নতুন আশায় বুক বাঁধেন পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য। সরকারি ও পাউবো’র যথাযথ ব্যবস্থা পেলে তারা তাদের ভাগ্যের চাকা আরো দ্রুতগতিতে ফেরাতে পারবে বলে মনে করেন বানভাসীরা।
সুভদ্রাকাটি বাঁধের উপর টোঙ বেঁধে মানবেতর জীবন-যাপনকারি পরিবার গুলির জন্য প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুত আশ্রয়ন প্রকল্প-২ এর কাজ দ্রুত সম্পন্ন, যথাসময়ে ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলি মেরামত ও স্থায়ী সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন এলাকাবাসী।