ভ্যান গাড়ির চাকায় ঘুরছে কলেজ ছাত্র রাসেলের স্বপ্ন

প্রকাশঃ ২০১৯-১০-২৫ - ১৮:১৮

ইমতিয়াজ উদ্দিন : ভালো খাবার আর ভালো পোশাক জোটেনি কোনো দিন। কাঠ ফাটা রোদ কিংবা ঝড়ো বৃষ্টি কোন কিছুতেই যেন বিশ্রামের সুযোগ নেই। ভ্যানের চাকা না ঘুরলে সংসারের চাকা যে ঘুরবেনা। তার পরেও দারিদ্রতার কাছে হার মেনে শিক্ষার আলো থেকে দূরে থাকতে রাজী নয় কয়রার কপোতাক্ষ কলেজের একাদশ শ্রেণী প্রথম বর্ষের ছাত্র রাসেল। ভ্যান চালিয়েই লেখাপড়া আর সংসার চালাচ্ছে কয়রার গোবরা এলাকার ১৬ বছর বয়সের এই কিশোর। তার পুরো নাম মোঃ রাসেল হোসেন।
কয়রা সদর থেকে ঘাটাখালী বেড়ীবাঁধ এলাকায় যাবার পথে কথা হয় রাসেলের সাথে। অত্যন্ত বিনয়ী আর ভদ্র ছেলেটির সাথে কথা বলে জানাযায়, তার স্বপ্ন– লেখাপড়া করে ভবিষ্যতে সে শিক্ষক হবে। ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করবে। পরিবারের অভাব মিটিয়ে সে তার অসহায় বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাবে।
রাসেল জানায়, অভাবের কারণে একপর্যায়ে তার লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই ভ্যানের প্যাডেলে পা রাখতে বাধ্য হয় সে। হতদরিদ্র বাবা রেজাউল গাজী দিনমুজুরি খেটে সামান্য যে টাকা রোজগার করেন তাই দিয়ে আর সংসার চলেনা। বয়সের ভারে বাবা এখন প্রায়ই থাকেন অসুস্থ। ছোট দু’ভাই ইব্রহিম ও ইয়াসিন স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে।
এ অবস্থায় সংসারের চাকা ঘোরাতে মেধাবী ছাত্র রাসেলের নতুন সংগ্রামী জীবন শুরু হয়। লেখাপড়ার পাশাপাশি কাকডাকা ভোরে ভ্যান নিয়ে কয়রার খুটিঘাটা খেয়াঘাট থেকে কয়রা সদরে ছুটে যায় রাসেল। এছাড়া প্রতি শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটিসহ কলেজ বন্ধের দিনে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে ভ্যান চালায়। ভ্যান চালানোর ফাকে নিয়ম করে সপ্তাহে ৪দিন কলেজে ক্লাস করে রাসেল। নতুন বই কেনার সামার্থ না থাকায় কয়রা বাজারের একটি লাইব্রেরী থেকে পুরাতোন কিছু বইও সংগ্রহ করেছে সে। গত কয়েকদিন আগে কলেজের ত্রয়মাসিক পরীক্ষা শেষ হবার পর পুনরায় রাসেল যখন ভ্যান চালানোর ফাকে ক্লাস করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল বিপত্তিটা দেখাদেয় তখন। হটাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়ে রাসেলের ছোট ভাই ইয়াসিন। ছোট ভাইয়ের চিকিৎসা ব্যায় মিটাতে গত একসপ্তাহ আর কলেজে যেতে পারেনি সে। একটু বেশি রোজগার করতে ক্লাসের সময়ও ধরতে হয়েছে ভ্যানের হাতল।
সারাদিন ভ্যানে যাত্রী টেনে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রাসেল যে টাকা রোজগার করে, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে রোজগারের সব টাকা সে তার বাবা-মায়ের হাতে তুলে দেয়। রাসেলের মা মাসুরা বেগম বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। রাসেলের বাপ দিনমজুর খেটে যে টাকা কামায় তা দিয়া সংসার চলে না। ছেলেকয়ডার মুখে ভালোমন্দো কোনো খাবার দিতে পারি না। তয়, রাসেল ভ্যান চালিয়ে যে টাকা রোজগার করে তা দিয়ে ছেলেদের লেখাপড়া আর সংসারের খরচ কোনমতে চলে যায়’।
তার বাবা মোঃ রেজাউল গাজী বলেন,‘ শিশু কাল থেকেই রাসেলের লেখাপড়ার প্রতি খুব ঝোঁক। তাই অভাবের সংসারের কথা চিন্তা করে রাসেল নিজের ইচ্ছায় ভ্যান চালিয়ে তার লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। রাসেলের জন্য সকলের কাছে দোয়া চান তিনি’।
কয়রা কপোতাক্ষ কলেজের প্রভাষক ও কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, শুনেছি আমাদের কলেজের একাদশ শ্রেণীর প্রথম বর্ষের ছাত্র রাসেল হোসেন ভ্যান চালিয়ে পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছেন। বাস্তবে এই সময়টি তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার পড়া লেখার প্রতি ভাল আগ্রহ রয়েছে। আশাকরি সে অবশ্যই ভাল কিছু করতে পারবে।
রাসেল জানায়, শত কষ্ট করেও লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছি। অভাব-অনটনের কারণে ঠিকমতো ক্লাস করতে পারিনা। প্রায় প্রতিদিনই ভ্যান চালাই। সাধারণত দুপুর দুইটার পর যাত্রী পাওয়া যায় না। তবু যাত্রীর জন্য বসে থাকি। মাঝে মাঝে শরীর সায় দেয় না। সেদিন একটু বিশ্রাম নেই।
কথা শেষ হতেই রাসেল আবার ভ্যান গাড়ির হাতলে হাত রাখে। পা রাখে প্যাডেলে। ছোট ভাইদের আবদার, মায়ের জন্য ঔষধ আর কলেজের পুরাতন একটা বই কিনতে টাকাটা জোগাড় করতে হবে যে।