মাইজভাণ্ডারী দর্শন

প্রকাশঃ ২০২১-০৫-২৫ - ২০:৩৩

মোঃ আরাফাত চৌধুরী: সুফিবাদ একটি ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন। আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা এর মুখ্য বিষয়। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল­াহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হলো এই দর্শনের মর্মকথা। ‘সুফ অর্থ পশম আর তাসাওউফের অর্থ পশমী বস্ত্রে পরিধানের অভ্যাস (লাব্সু’স-সুফ)- অতঃপর মরমীতত্ত্বের সাধনায় কাহারও জীবনকে নিয়োজিত করার কাজকে বলা হয় তাসাওউফ। যিনি নিজেকে এইরূপ সাধনায় সমর্পিত করেন ইসলামের পরিভাষায় তিনি সুফি নামে অভিহিত হন।’ (সংক্ষিপ্ত ইসলামি বিশ্বকোষ, প্রথম খন্ড, পৃ.৪৫২)

মাইজভাণ্ডারী দর্শন ইসলাম তথা সুফিবাদের কৃষ্টি সভ্যতার অংশ বিশেষ। মাইজভাণ্ডারী দর্শনের কথা উঠতেই সর্বপ্রথম উঠে আসে এ দর্শনে রয়েছে ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে সকলের উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার। আল্লাহ পাক স্বয়ং অসাম্প্রদায়িক৷ তাই এই মহান দর্শনেও ধর্মের কোন বাচ বিচার নেই। সকল ধর্মের সকল গোত্রের লোকের জন্য এই মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকা ও দর্শন পীঠস্থানে পরিনত হয়েছে। বাংলার জমিনে প্রবর্তিত একমাত্র ত্বরিকা হিসেবেও সর্বমহলে এর গ্রহনযোগ্যতা ব্যাপক। পৃথিবীতে অগনিত হক্কানী ত্বরিকা রয়েছে কিন্তু বাংলাদেশের জমিনে এটিই একমাত্র প্রবর্তিত ত্বরিকা। পূর্ববর্তী সকল ত্বরিকার মুল নির্যাস নিয়ে এ ত্বরিকার সৃষ্টি। বিশ্লেষণমূলক ভাবে বলতে গেলে, হযরত খাজা খিজির (আঃ) এর রহস্যময় খোদায়ী জ্ঞান, হযরত দাউদ (আঃ) এর অবলুপ্ত সুরের ব্যাঞ্জনা, হযরত সোলাইমান (আঃ) এর রাজকীয় ঐশ্বর্য, হযরত আইয়ুব (আঃ) ধৈর্যের না ভাঙ্গা বাধ, হযরত ঈসা (আঃ) প্রেমের বানী, বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (দ.) এর বেলায়তী শান, আহমদী নামের যুগউপযোগী পদাচারনা খ্যাত, প্রখ্যাত সাহাবী আবূ হুরায়রা (রঃ) এর না বলা কথার কথক অবলম্বন করেই মাইজভাণ্ডারী দর্শনের প্রবর্তন।

এই পূতপবিত্র দর্শন একটি ধর্মীয় বিপ্লব, একটি আদর্শ ইসলামী চেতনা। এই দর্শন মূলত রাসুলে পাক (দ.) এর মদিনা সনদেরই আদলে গড়া। সুফিবাদের প্রচার ও প্রসার এবং চর্চার জন্য এই দর্শন একটি ঈমানী ক্যান্টনমেন্ট। এই মহান মাইজভাণ্ডারী দর্শন খোদার রহস্যময় জ্ঞানের ভাণ্ডার। জ্ঞানপিপাসু খোদা সন্ধানী লোকদের জন্য এই দর্শন একটি আদর্শ পাঠশালা। মাইজভাণ্ডারী দর্শনের লক্ষ বা উদ্দেশ্যসমুহ বহুমুখী এবং ব্যাপক। সংখ্যার নিগঢ়ে এগুলোকে আবদ্ধ করে শেষ করা যাবেনা। কারন; একজন মানুষের দেহ, মন, চিন্তাধারা, আত্মা, তথা প্রতিটি অঙ্গ- প্রত্যঙ্গের সর্ববিধ শুদ্বাচার অনুশীলনই হচ্ছে মাইজভাণ্ডারী দর্শনের মুল কথা।

এই মাইজভাণ্ডারী দর্শনে রয়েছে সার্বজনীনতা, ধর্মসাম্য ও বিশ্বমানবতা। জাতি ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে সকল ধর্মের মানুষের অধিকার প্রতিষ্টাই হল মাইজভাণ্ডারী দর্শনের বৈশিষ্ট্য। এখানে হিন্দু -মুসলিম, বৌদ্ধ -খ্রীষ্টান সকল ধর্মের মানুষই নিজের ধর্মে অবিচল থেকে সঠিক ধার্মিকতা পালনের মাধ্যমে এক স্রষ্টার ধ্যানে জ্ঞানে মশগুল হয়। মাইজভাণ্ডারী দর্শনের ভাব -ভাবনা, চিন্তা- চেতনা, ধ্যান- ধারনা সকলই বিশ্বব্যাপি ব্যাপ্তির। মানুষে মানুষে সম্প্রীতি ও ভালবাসার শিক্ষা দেয় এ মাইজভাণ্ডারী দর্শন।

মাইজভাণ্ডারী দর্শনের অন্যতম প্রধান লক্ষ ও উদ্যেশ্য সমুহের মধ্যে রয়েছে।
*নিছক পার্থিব স্বার্থপরতাকে পরিহার করে পরিপূর্ণতা অর্জনের মাধ্যমে স্রষ্টার নৈকট্য হাসিল করা।
*বিশ্বের ধর্ম বিরোধ মিটিয়ে সার্বজনীন ধর্মসাম্যের আদর্শ প্রতিষ্টা করা।
*সত্য ও ন্যায় পথে জীবন যাপনে মানব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করা।
* মানুষের মানবিকগুনের বিকাশ সাধন করা।
* পার্থিব ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ সুনিশ্চিত করা।
* স্রষ্টাকে ভালবাসার মাধ্যমে জয় করা।
* সকল নৈতিক অবক্ষয় রোধ পূর্বক ব্যাক্তিগত ও সামাজিক শান্তি প্রতিষ্টা করা।

পৌত্তলিকতাবাদ, নাস্তিকতাবাদ, ও ধর্মীয় গোড়াবাদে নিমজ্জিত হয়ে গোটা বিশ্ব চরম নৈতিক অবনতির সম্মুখীন হয়। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, সর্বনাশা – গৃহযুদ্ব, স্বৈরাচার, পার্থিব লোভ লালসা, সাম্প্রদায়িক হানাহানি, প্রতারণা প্রভৃতি নৈতিক অবক্ষয়মূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে গোটা মানব সমাজ চরম অবস্থায় উপনিত হয়। ধর্ম যুগ ও জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে পাপাচারে নিমজ্জিত মানবসমাজকে উদ্বারকল্পে মুক্তি দেওয়ার জন্য, অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনার জন্য এবং ধর্মের সত্তিকার স্বরুপ প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বত্রানকর্তৃত্ব সম্পন্ন গাউসুল আযম রুপে হুজুর গাউসুল আযম মাওলানা শাহ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী এ ধরাধামে আবির্ভূত হন। মানব সমাজকে ঐশী প্রেমের আলোয় আলোকিত করতে সৃষ্টি করেন পবিত্র মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকা বা মাইজভাণ্ডারী দর্শন।
রুমিয়ে বাঙ্গাল, হযরত মাওলানা বজলুল করিম মন্দাকিনীর ভাষায়,
“যুগে যুগে তুমি বিভিন্ন প্রদেশে, নবী অলী নামে মুনিঋষী বেশে ;
ঘোর অন্ধকার হতে মানবীকে আলোকে টানিয়ে আন।”

 

অর্গলমুক্ত ঐশী প্রেমবাদ এই দর্শনের অন্যতম বিষয়বস্তু। এই অর্গলমুক্ত ঐশী প্রেমবাদ বিশ্ব মানবতার জন্য হযরত গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর (রাদ্বিঃ) একটি দুর্লভ অবদান। যার মূল উদ্যেশ্য হল খোদার একত্ব প্রকাশ করা। মহাপ্রভুর একত্বে মিলনের পথ হচ্ছে অর্গলমুক্ত ঐশী প্রেমবাদের পথ। এটি পবিত্র কোরআন ও হাদীসের মেরুদণ্ড ও সুক্ষ্ম উদ্দেশ্য। এই প্রেমবাদ উচ্চতর ক্ষমতাসম্পন্ন বাধাহীন বিকাশ ও সর্ব বেষ্টনকারী বেলায়তী শক্তি যা জাতি ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য চির উন্মুক্ত। স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন, চূড়ান্তভাবে আত্মসমর্পণ এবং স্রষ্টার নৈকট্য অর্জন হচ্ছে মাইজভাণ্ডারী দর্শনের অন্যতম লক্ষবস্তু। মহান আল্লাহ পাক বলেন, ” অতএব, তোমরা আমাকে স্বরন কর, আমি তোমাদেরকে স্বরনে রাখব এবং তোমরা আমার নিকট কৃতজ্ঞ হও এবং অবিশ্বাসী হয়োনা।” (সুরা বাকারা; আয়াতঃ – ১৫২)

মূলত মাইজভাণ্ডারী দর্শন স্রষ্টা এবং সৃষ্টির সাথে একটি সেতুবন্ধন। মহান স্রষ্টার অগনিত নেয়ামত এর শুকরিয়া তথা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং প্রতিনিয়ত এক ও অদ্বিতীয় স্রষ্টার জিকিরে মশগুল থাকার শিক্ষা দেয় এই দর্শন। একজন সাধারণ ইনসানকে পার্থিব ও আধ্যাত্মিক কল্যান সুনিশ্চিত করে ভালবাসার মাধ্যমে স্রষ্টাকে জয় করার শিক্ষা ও দীক্ষা দেয় এই মাইজভাণ্ডারী দর্শন।