মরার পরে চালনাবাসী যেন আমাকে কবরস্থ করে
আজগর হোসেন ছাব্বির হোসেন, দাকোপঃ দূর্যোগময় পরিস্থিতিতে বইছে শীতের হিমেল হাওয়া। রাত গভীর হয়ে গেছে চারিদিকে নীরবতা। এমন শুনশান নীরবতার মাঝে তাকিয়ে দেখি ফুটপথের মাঝে কোন একজন রাত্রি যাপনের বিছানা করছে। কৌতুহল বেড়ে যাওয়ায় কাছে এগিয়ে গেলাম। দেখি বয়বৃদ্ধ একজন মানুষ রাস্তার বৈদ্যুতিক বাতির আলো আধারিতে রাতে ঘুমানোর জন্য চটের বস্তা বিছিয়ে মশারি টানাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম কি নাম আপনার, অ¯পষ্ট গলায় বললো রাজা মিয়া, প্রথমবার বুঝতে কষ্ট হওয়ায় দ্বিতীয়বারের বলায় নামটি জানতে পারলাম।
দাকোপ উপজেলা সদর চালনা পৌরসদর ডাকবাংলার মোড় শরীফ টেলিকমের সামনে ফুটপথ থেকে গত ৯ ডিসেম্বর শনিবার দিবাগত রাত ১১ টার দিকে আবিস্কার করলাম ৭০ উর্দ্ধ বয়সের এই রাজা মিয়াকে। শীতের হিমেল হাওয়ায় কোন পাগলকেও যখন খোলা আকাশের নীচে দেখা যায়না তখন এভাবে ফুটপথে স্বযতেœ বিছানা করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেওয়া কে এই রাজা মিয়া, কেনই বা এমন জীবন যাপন জানার আগ্রহ বেড়ে যায়। প্রথমেই জানলাম আমাকে সে ভালভাবেই চেনে। তাইতো ওই রাতে আমার প্রশ্নে বিরক্ত না হয়ে বলে গেল রানীকে হারিয়ে রাজা মিয়ার ফুটপথের বাসিন্দা হওয়ার কাহিনী। জানা যায় নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার চোড়খালী বড়দিয়া তাঁর আদি নিবাস। পিতার নাম মৃঃ লালচাঁদ মিয়া। ৩ ভাই ২ বোনের মধ্যে রাজা মিয়া ছাড়া সকলেই মারা গেছে। দিন তারিখ বছর ঠিকমত মনে নেই, তবে আনুমানিক ১৯৪০ সালের পর তারই গ্রামের এক সময়ের বাসিন্দা চালনা বাজারের ব্যবসায়ী মনি সাহা ও বাসুদেব সাহার হাত ধরে কৈশরের দুরন্ত রাজা মিয়া চালনা বন্দর এলাকায় আসে। চালনার তৎকালীন হোটেল ব্যবসায়ী নিতাই সাহার দোকানে থেকে পথচলা শুরু। একসময় লঞ্চে ফেরী করে রুটি সন্দেশ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। কিশোর পেরিয়ে যুবক হলে সুদর্শন রাজা মিয়া যৌবনের আকর্ষনে মুগ্ধ করে আশ্রয়দাতা নিতাই সাহার স্ত্রী ৫ সন্তানের জননী রানীকে বিয়ে করে। রানীকে সাথে নিয়ে শুরু করে সংসারি জীবন। পরকীয়া প্রেমের ডাকে সাড়া দিয়ে হারিয়ে ফেলে আশ্রয়স্থল। নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে শ্রম বিক্রিসহ নানা পেশায় চলে রাজা মিয়ার জীবন সংসার। শরীরের শক্তি কমে আসলে দাকোপ উপজেলা বিএনপির কার্যালয়ের এক কোনে নিঃসন্তান রাজা মিয়া রানীকে নিয়ে গড়ে তোলে আশ্রয়স্থল। সারাদিন কার্যালয়ের সামনে ফুটপথে পান সিগারেট বিক্রি করে। এভাবে চলতে থাকে রাজা মিয়ার সংগ্রামি জীবন। ৭-৮ বছর গত হয়েছে রাজা মিয়ার একমাত্র আপনজন রানী মারা যায়। এরপর মনের দুঃখে কষ্টে সিদ্ধান্ত নেয় আপনজনদের কাছে ফিরে যাওয়ার। সেই মোতাবেক রাজা মিয়া যৎসামান্য পুজির পান দোকানের সকল মালামাল কোন এক গরীব ভ্যান ওয়ালাকে দান করে ফিরে যায় কালিয়ার পিতৃভ’মিতে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। জানতে পারে বেশ আগেই রাজা মিয়ার মা বাবা ভাই বোন সকলেই এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে পরকালে। এই ভুবনে রাজা মিয়ার আপন বলতে আর কেউ নেই। তাই সেখান থেকে আবার ফিরে আসে দাকোপ উপজেলা সদর চালনায়। কিন্তু এবার পূর্বের আশ্রয়স্থল ও নেই। বয়সের ভারে চোখে ঠিকমত দেখতে পায়না কানেও ভাল শুনতে পায়না। অসহায় রাজা মিয়ার জীবনের মুল্যবান সময় যে মানুষদের মাঝে কেটেছে সেই চালনাবাসীর দয়ার উপর চলছে তার জীবন। জানা যায় স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ী আমিরুল গাজী এবং দাকোপ উপজেলা হাসপাতাল রাজা মিয়ার দিনের খাওয়ার দিয়ে থাকে। রাতের ঠিকানা তাই নিজেই ঘুছিয়ে নিয়েছে ফুটপথের চালের বস্তার বিছানা। জীবনের এই কাহিনী বলার সময় চোখের পাতা ভিজে যায় রাজা মিয়ার। বার বার চোখের পানি মুছে শেষ কথাটি বলে আমার রানীকে হারিয়ে এখন আমি নিঃস্ব। মরার পরে চালনাবাসী যেন আমাকে কবরস্থ করে।