রোপণের পরই মরে যাচ্ছে পেঁয়াজের চারা, দিশেহারা কৃষক

প্রকাশঃ ২০২৩-০১-২৯ - ১২:৩৫

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি : কুমারখালী উপজেলার পান্টি ইউনিয়নের সান্দিয়ারা গ্রামের কৃষক মো. শফিকুল ইসলাম (৫৩)। তিনি প্রতি বছরের মতো এবছরও প্রায় চার বিঘা জমিতে পেঁয়াজের চারা রোপণ করেছেন। চারা রোপণের পর প্রায় ২০ দিন অতিবাহিত হয়েছে। এরইমধ্যে জমিতে দুবার সেচও দিয়েছেন। কিন্তু চারা বড় হওয়ার পরিবর্তে চারার মাথা হলুদ হয়ে ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে। চার বিঘা জমিতে পেঁয়াজের চারা রোপণ ও সেচ দিয়ে তার প্রায় এক লাখ ২০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে।

শুধু শফিকুলই নন, সান্দিয়ারা গ্রামের শতাধিক পেঁয়াজ চাষির একই অবস্থা। তারা পেঁয়াজ চাষাবাদ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। সান্দিয়ারা গ্রামের কৃষক আজিজুর রহমান (৪৫) বলেন, শফিকুলসহ এই গ্রামের শতাধিক চাষি ইউনিয়নের ডাঁসা গ্রামের অবেদ আলীর ছেলে ও বীজ ব্যবসায়ী মো. কামির হোসেনের (৩৮) কাছ থেকে দুইশ কেজি ভারতের বীজ কিনেছিলেন। তার দুই বিঘা জমির পেঁয়াজসহ সব কৃষকের পেঁয়াজই মরে যাচ্ছে।

শফিকুল জানান, কামির হোসেনের কাছ থেকে ১৮ হাজার টাকায় চার কেজি কিং জাতের পেঁয়াজ বীজ কিনে জমিতে চারা রোপণ করেছিলেন। কিন্তু রোপণের পর চারায় শিকড় গজাচ্ছে না। ধীরে ধীরে চারার মাথা মরে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। এবার বিঘাপ্রতি চারা রোপণে তার প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।

জানা গেছে, বীজতলা থেকে পেঁয়াজের চারা তুলে জমিতে চারা রোপণের পরপরই সেচ দেন কৃষকরা। সেচের পানি চারায় শিকড় গজাতে ও মাটি আঁকড়ে ধরে রাখতে সহযোগিতা করে। কিন্তু এবছর চারা রোপণের পর জমিতে সেচ দেওয়া হলেও চারায় শিকড় গজাচ্ছে না। চারার মাথা হলুদ হয়ে ধীরে ধীরে চারা গাছটি মরে জমিতে মিশে যাচ্ছে। প্রতিটি গ্রামের মাঠের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জমির পেঁয়াজ মারা যাচ্ছে।

উপজেলার যদুবয়রা, পান্টি, চাঁদপুর ও বাগুলাট ইউনিয়নের বিভিন্ন পেঁয়াজের মাঠ ঘুরে দেখা যায়, মাঠে কৃষকরা পেঁয়াজ, গম, সরিষা, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ করছেন। এর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জমির পেঁয়াজের চারায় শিকড় গজায়নি। চারার মাথায় হলদে ভাব নিয়ে ধীরে ধীরে মরে জমিতে মিশে যাচ্ছে। কেউ কেউ মরা পেঁয়াজের জমিতে পুনরায় পেঁয়াজের চারা রোপণ করছেন। আবার কেউ পেঁয়াজের চারা বুনে লোকসান হওয়ায় ভুট্টা বা ধানের চাষাবাদের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

চাঁদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদুজ্জামান তুষার বলেন, প্রতি বছর প্রণোদনায় কৃষকদের নাম না পাঠিয়ে বিপাকে পড়তেন তিনি। এবছর পেঁয়াজের চারা মরে যাওয়ায় প্রণোদনাপ্রাপ্ত কৃষকরা পথেঘাটে তাকে অপমান-অপদস্ত করছেন।

যদুবয়রা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজান বলেন, তার ইউনিয়ন থেকে এ বছর ১৭ জন কৃষক পেঁয়াজের প্রণোদনা পেয়েছিলেন। ১৭ জনেরই চারা মরে গেছে। কৃষকদের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি। এদিকে পান্টি ইউনিয়নের ডাঁসা গ্রামের বীজ ব্যবসায়ী মো. কামির হোসেন চাষিদের পেঁয়াজ চারা মারা যাওয়ার খবর জানার পর থেকেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন।

ওই ব্যবসায়ীর স্ত্রী জানান, তার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে বীজের ব্যবসা করছেন। কোনো দিন এমন হয়নি। তবে এ বছর কেন চারা মরে যাচ্ছে তা তিনি জানেন না। কৃষকরা প্রতিদিনই বাড়িতে এসে ঝামেলা করছেন, সেজন্য তার স্বামী পালিয়ে গেছেন। কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ির) উপপরিচালক ড. হায়াত মাহমুদ বলেন, কুষ্টিয়ার ছয়টি উপজেলার মধ্যে কুমারখালী উপজেলায় বেশি পেঁয়াজের আবাদ হয়। চারা রোপণের পর চারা হলুদ হয়ে মরে যাচ্ছে এ ধরনের বেশ কিছু অভিযোগ তাদের কাছে এসেছে।

এর কারণ হিসেবে তিনি জানান, সাধারণত ১৫ ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে একাধিক শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যায়। এ সময় তাপমাত্রা একেবারেই কমে যায়। টানা তিন চারদিন যদি এ ধরনের শৈত্যপ্রবাহ চলে আর এ সময় যদি চারা রোপণ করা হয় তাহলে অতিরিক্ত ঠান্ডার কারণে পেঁয়াজসহ যেকোনো চারা মারা যাওয়া স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে সেটিই ঘটেছে। আমরা কৃষকদের অতিরিক্ত ঠান্ডা পড়লে চারা রোপণ না করার জন্য বার বার সতর্ক করলেও তারা আমাদের কথা কর্তপাত করেনি।

সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এ বছর ১৩ হাজার ৭৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৯ হাজার ২৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ সম্পন্ন হয়েছে। বাজারে ভেজাল বীজ থাকা অস্বাভাবিক নয় স্বীকার করে কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ির) উপপরিচালক ড. হায়াত মাহমুদ বলেন, আমরা কৃষকদের বার বার সতর্ক করছি ডিলার ছাড়া অনুমোদিত বা অন্য কোনো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কোনো ধরনের বীজ ক্রয় না করার জন্য। কিন্তু অনেক সময় কৃষকরা ডিলারদের কাছ থেকে বীজ না কিনে অন্য জায়গা থেকে বীজ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন।