চট্টগ্রাম ব্যুরো:কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালীতে রোহিঙ্গাদের পাঁচটি ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১০ হাজার রোহিঙ্গাদের ঘর পুড়ে গেছে। একই সাথে স্থানীয়দের ৩শ মত ঘর পুড়ে গেছে। মারা গেছেন শিশুসহ অন্তত ৭ জন নারী পুরুষ।
আগুনে অন্তত ২ হাজার মানুষ কমবেশি আহত হলেও ১০১জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কক্সবাজারের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
রাত ২:৩০ টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
ফায়ার সার্ভিসের সাতটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। পাশাপাশি সেনাবাহিনী, পুলিশসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার স্বেচ্ছাসেবী কর্মীরা এতে যোগ দিয়েছে। ক্যাম্পের ঘরগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা লাগোয়া আর বাতাসের গতিবেগ থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হচ্ছে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে রাতে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিজাম উদ্দীন আহমদ জানিয়েছেন, অগ্নিকাণ্ডে প্রাথমিক হিসাব মতে ৯ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা পরিবারের ঘর পুড়ে গেছে। তিনি জানান, ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী গ্রামেরও শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামের লোকজন বালুখালী কাসেমিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হাজার হাজার লোক আশ্রয়স্থল হারিয়ে এক কাপড়ে আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কে। আশ্রয়হারা লোকজন হারিয়েছে তাদের ক্যাম্পের ঝুপড়ি ঘরের সব মালামাল। আবার অনেকেই হারিয়েছে তাদের সন্তান-সন্ততিও। শফিকা বেগম নামের এক রোহিঙ্গা নারী আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচতে তার ৫ সন্তানকে নিয়ে মহাসড়কে আশ্রয় নিতে ছুটোছুটি করতে গিয়ে ৭ বছরের এক শিশু সন্তানকে হারিয়েছে।
রোহিঙ্গা নারী শফিকা অঝোর নয়নে কাঁদছে তার হারানো শিশু সন্তানের জন্য। শফিকার মতো এরকম রোহিঙ্গা নারীর আহাজারি চলছে মহাসড়কের বালুখালী এলাকার বিস্তৃত এলাকা জুড়ে। বালুখালী ক্যাম্পের আবদুস শুকুর নামের অপর একজন রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, ক্যাম্পটির ৮ নম্বর ব্লক থেকেই আগুনের সূত্রপাত ঘটে। একটি ছনের ছাউনির ঘর থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। আগুন দেখে আবদুস শুকুর তার স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদের নিয়ে দৌঁড়ে কোনো রকমে আশ্রয় নেয় কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কে।
কক্সবাজারে অতিরিক্ত ত্রাণ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. সামছু-দৌজা নয়ন জানিয়েছেন, সোমবার বিকেল ৩টায় উখিয়ার বালুখালী ৮-ডব্লিউ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন লাগে। ক্যাম্পটির লাগোয়া ৮-এইচ, ৯, ১০ ও ১১ নম্বর ক্যাম্পেও সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি বলে জানান এ কর্মকর্তা।
সামছু-দৌজা নয়ন বলেন, বাতাসের গতিবেগ বেশি হওয়ায় আগুন দ্রুত পার্শ্ববর্তী ক্যাম্পগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। তবে কতগুলো বসতঘর পুড়েছে, আর কতজন আহত বা নিহত হয়েছে, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এ কর্মকর্তা জানান, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক কর্মী ও স্থানীয়রা মিলে তা নেভানোর চেষ্টা চালান। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে যোগ দেন।
অতিরিক্ত ত্রাণ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার বলেন, ফায়ার সার্ভিসের উখিয়া স্টেশনের দুটি ইউনিটের পাশাপাশি টেকনাফের দুটি, কক্সবাজারের দুটি এবং রামুর একটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ক্যাম্পগুলো থেকে লোকজনকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়।
কুতুপালং ক্যাম্পের সিআইসি খলিলুর রহমান খান জানিয়েছেন, আগুনে ৮ ও ৯ নম্বর ক্যাম্প দুটি সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। এ ছাড়া ১০ ও ১১ নম্বর ক্যাম্পের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিক তথ্যে জানা গেছে, ৯ হাজার ৬শ এর অধিক বসতঘর পুড়ে গেছে। তিনি জানান, আগুনে দুই শিশু নিহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেলেও সরকারিভাবে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আহতের সংখ্যা জানা যায়নি।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আগুনে কুতুপালং বলিবাজার এলাকার স্থানীয় বাজারের শতাধিক দোকান পুড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থানীয়দের। পুড়ে গেছে ৮ ও ৯ নম্বর ক্যাম্পে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম এবং এমএসএফ পরিচালিত তিনটি ফিল্ড হাসপাতাল। দগ্ধ লোকজনকে নিকটবর্তী উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেপসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন আহমেদ জানান, অগ্নিকাণ্ডের পর রোহিঙ্গারা ঘরবাড়ি ছেড়ে সড়কের উভয় পাশে অবস্থান নেয়। দীর্ঘ ৪ ঘণ্টাব্যাপী কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে যান চলাচল বন্ধ ছিল। সন্ধ্যা ৭টা থেকে যান চলাচল ফের শুরু হয়। পুরো ক্যাম্প এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
সোমবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ, পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান, ত্রাণ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজোয়ান হায়াত ঘটনাস্থলে পৌঁছেন। আগুন নিয়ন্ত্রণে সংশ্নিষ্টদের কাজ তদারকি করেন তারা।