লকডাউনে শিক্ষক অমিত এখন ফুটপাতের সবজি বিক্রেতা

প্রকাশঃ ২০২১-০৫-০৭ - ১৮:১০

মুকুল রায়: বিএ বিএড পাশ অমিত সাহা জয় এখন ফুটপাতের সবজি বিক্রেতা। জয় স্যার নামে যিনি পরিচিত এক মুখ। প্রতিদিন সবজি নিয়ে বসেন নগরীর সিমেট্রি রোডের সাহেবের কবরখানার সামনে। শিক্ষিত যুবক অমিতের ছিল নিজের প্রতিষ্ঠান। শিশুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিন্ডারগার্টেন স্কুল। করোনার কারণে লকডাউনে বন্ধ রয়েছে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিদ্যানিলয় কিন্ডারগার্টেনটি। এক বছরের বেশি সময় আয় রোজগার নেই তার। রয়েছে পরিবার, রয়েছে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার খরচ। তাই বাধ্য হয়েই এখন সবজি বিক্রি করে কিছুটা আয়ের চেষ্টা করছেন অমিত। স্বপ্ন টিকিয়ে রাখতে এখন চলছে অমিতের অন্য সংগ্রাম।
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড আর শিক্ষক তার চালিকা শক্তি। কিন্তু অদৃশ্য শক্তি কোভিড-১৯ সেই শিক্ষা ও শিক্ষককে আজ করেছে মেরুদণ্ডহীন! প্রায় ২১ বছর পূর্বে অমিতের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যানিলয় কিন্ডারগার্টেনটি এখন তার অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। মৃত্যু ঘটতে বসেছে একজন শিক্ষকের লালিত স্বপ্নের। গত বছরের ১৭ মার্চ শিক্ষামন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণায় বিদ্যানিলয় কিন্ডারগার্টেনটি প্রায় ১৫০ জনের অধিক শিক্ষার্থী নিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম দফায় ৪ঠা এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন থাকলেও পরবর্তীতে করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ায় সরকার দফায় দফায় লকডাউনের সময়সীমা বাড়াতে থাকেন। অমিতও সোনালি দিনের আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকেন। দিন গড়িয়ে মাস, বছর শেষে নতুন বছরে আবারও স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন। চলতি বছরের শুরুতে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো থাকলেও মার্চের মাঝামাঝি করোনা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় সরকার আবারও লকডাউনের ঘোষণা দেন। অমিত নিরুপায় হয়ে ধার করে টাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠান ধরে রাখতে ও সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে নেমে পড়েন সবজি বিক্রি করতে। সোনাডাঙ্গার সবজি আড়ত থেকে সবজি কিনে নগরীর সিমেট্রি রোডে সাহেবের কবরখানার সামনে ফুটপাতে বসে বিক্রি করেন বিভিন্ন সবজি। গতকাল রাতে সরজমিনে দেখা যায় তিনি ফুটপাতে বিভিন্ন রকমের সবজি নিয়ে বসে আছেন। তিনি এই প্রতিবেদককে অশ্রুসিক্ত নয়নে, ভাঙা কন্ঠে বলেন, শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা নিয়েও অত্যন্ত নিরুপায় হয়ে ফুটপাতে সবজি নিয়ে বসেছি। গত এক বছরের বেশি সময় বেকার থেকে মুক্তি পেতে ও প্রতিষ্ঠানকে ধরে রাখতে তিনি এ ব্যবসায় নেমেছেন। যদিও এ ব্যবসা থেকে যেটুকু আয় হচ্ছে তা দিয়ে প্রতিষ্ঠান ভাড়া ও নিজের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে অমিতকে। কথা প্রসঙ্গে জানা যায় তিনি বিএ বিএড পাশ করে ২০০০ সাল থেকে নগরীর ফুল মার্কেটের অদূরে বিদ্যানিলয় কিন্ডারগার্টেনটি সুনামের সাথে পরিচালনা করে আসছেন। বর্তমানে তিনি প্রতিষ্ঠানটির ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা ব্যয় করছেন। আপনি কেন প্রতিষ্ঠানটি ছাড়ছেন না, এমন প্রশ্নে স্মৃতি বিজড়িত কণ্ঠে বলেন, এটি তার স্বপ্নের, ভালো লাগার, ভালোবাসার প্রতিষ্ঠান। তিনি প্রতিষ্ঠানটি ছাড়তে চান না। আঁকড়ে রাখতে চান তার লালিত স্বপ্নকে। ফিরে পেতে চান সেই দিনগুলো, যেখানে মুখর হয়ে থাকবে তার প্রতিষ্ঠান কচিকাঁচাদের কোলাহলে। কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশনের খুলনার মুখপাত্র মাজারুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে আমাদের টিকে থাকাটা দ্বায় হয়ে পড়েছে। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বেকার হয়ে পড়েছে হাজার হাজার শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারি। প্রতিষ্ঠান ভাড়া দিতে দিতে আমরা নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। তিনি আরও জানান, গত বছর খুলনা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে আমরা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রণোদনা ও সহযোগিতা পাওয়ার আবেদন জানিয়েছিলাম। কিন্তু সেখান থেকে আমাদের আশানুরূপ কোনো ব্যবস্থা করা হয় নি। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, প্রধানমন্ত্রী কিন্ডারগার্টেনের দুর্দশার কথা বিবেচনা করে কোনো না কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। অন্যথায় দুর্দশার সীমা থাকবে না। গ্রীনলীফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অধ্যক্ষ জেসমিন নাহার বলেন, কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর দুর্দশার চিত্র প্রিণ্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সেভাবে তুলে ধরা হচ্ছে না। বিধায় আমরা চরম হতাশায় ভুগছি এবং কোনোরূপ সরকারি সহযোগিতা পাচ্ছি না। তিনি করোনাকালীন সময়ে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে সাংবাদিকদেরকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানান। এ বিষয়ে এডিসি শিক্ষা সাদিকুর রহমান বলেন, কিন্ডারগার্টেনের জন্য সরকারি কোনো প্রণোদনা বা অনুদান এখনও পর্যন্ত আমাদের কাছে আসে নি। তবে আগামী মিটিং এ বিষয়টি উত্থাপন করব। ইতোমধ্যে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোকে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
শুধু অমিত সাহা নয়, সহস্র-লক্ষ কিন্ডারগার্টেনের পরিচালক ও শিক্ষকদের মনের আকুতি ফিরে আসুক সেই ফেলে আসা সোনালি দিনগুলো। মুক্তি পাক অদৃশ্য জীবাণুর হাত থেকে গোটা বিশ্ব। অবাধ বিচরণ ঘটুক কোমলমতি শিশুদের।