জয় মারমা,লামা (বান্দরবান) প্রতিনিধিঃ অন্ধকারাচ্ছন্ন শ্রেণি কক্ষ। ভবনে দেয়াল ও বারান্দায় ফাঁটল। ছাদের ভীম ভেঙ্গে বৃষ্টি পানি শ্রেণিকক্ষে। প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের ছাদের বীম, ইট-সুরকি খসে পড়ে ঝং পড়া রড বেরিয়ে কঙ্কালের পরিণত। দরজা-জানালার অবস্থাও নাজুক। সেই সঙ্গে সামান্য বৃষ্টি হলেই ছাদ চুইয়ে পড়ে পানি। ভয় হয়। তবুও এর মধ্যেই বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস করছে। তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে মাঝে মধ্যে উপরের দিকে তাকাচ্ছে। শঙ্কা কখন বা মাথার উপর খসে পড়ে ইটের টুকরা। এসব আতঙ্কে দিন দিন শিক্ষার্থীর উপস্থিতির হার যেমন কমছে তেমনি ব্যাহত হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষা কার্যক্রম। এমন চিত্র দেখা মিললো বান্দরবান জেলার লামা উপজেলায় ১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। ভবনগুলোর এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে কোন সময় ছাদ, বীম ও পিলারের অংশ ধসে পড়ে বড় ধরনের দূর্ঘটনা ঘটতে পারে।
উপজেলায় মোট ৮৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ১০টি বিদ্যালয়ের ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ ও জরাজীর্ণ। এর মধ্যে অত্যন্ত ঝুঁকিপূণ বিদ্যালয় পাঁচটি। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয়গুলো হলো, আজিজনগর ইউনিয়নে ইসলামপুর বি আলম ও ০২নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, লামা পৌর শহরে রাজবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রূপসী পাড়া ইউনিয়নে দরদরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ফাইতং হেডম্যান পাড়া বিদ্যালয়। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা২ হাজার ৫শত ৫১জন। ভবন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় ঝুঁকি নিয়ে পরিত্যক্ত ভবনেই চলছে শিক্ষা কার্যক্রম।
এদিকে পরিত্যক্ত তালিকায় নাম না থাকলেও ভবনের অবস্থা জরাজীর্ণ, এমন বিদ্যালয়ও রয়েছে। যার মধ্যে লামা পৌর শহরে চেয়ারম্যান পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ,ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে শহীদ জিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সরই ইউনিয়নে জুরেমণি পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ডান-বাম হাতি ছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ০৩নং রেফজি পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে পাঠদান না করার জন্য এবং বিকল্প নিরাপদ স্থানে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে উপজেলা শিক্ষা অফিস বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিলেও তা মানা হচ্ছে না। আর বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, কক্ষ সংকটের কারণে বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে পাঠদান করাতে হচ্ছে। এসব ভবনে পাঠদান বন্ধ করলে বিদ্যালয়ই বন্ধ করে দিতে হবে।
গত মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, লামা পৌর শহরে চেয়ারম্যান পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিনটি ভবনের মধ্যে একটি ঝুঁকিপূর্ণ ও জরাজীর্ণ। ভবনটি বীম ভেঙ্গে খসে পড়ছে। ভবনের বারান্দার স্তম্ভগুলো বিপজ্জনকভাবে ফেটে গেছে। ধসের আতঙ্কে দুইটি কক্ষ তালা মেরে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে কক্ষ সংকটের কারণে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সে র্জীণ ভবনে বৃষ্টি মাঝে ছাতি খোলে পাঠগ্রহণ করছে। প্রধান শিক্ষক আবদুর রহিম বলেন, একদিকে ভবন ধসের আতঙ্ক, অন্যদিকে শিক্ষকের সংকটময়। অবকাঠামো উন্নয়ন বা সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষ আর এলজিইডি জায়গা মেপে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক স্বপ্নও দেখিয়েছে কিন্তু আজো পর্যন্ত বিদ্যালয়ের কোন উন্নয়নের ছোয়া লাগেনি। বিদ্যালয়ের জন্য আমিসহ মোট ১০জন শিক্ষকের পদ থাকলেও, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষকসহ দুইজন শিক্ষক মাতৃত্বকালীন ছুটিতে, একজন ডিপিএড ট্রেনিং রয়েছে। আবার গত ১০ জুলাই/১৭ইং জেলা শিক্ষা অফিসারের স্বাক্ষরিত একজন শিক্ষককে নাইক্ষ্যছড়ি উপজেলায় ডেপুটেশনে দেওয়া হয়। প্রাক থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী রয়েছে মোট ৩৬১জন।
একই দিনে রাজবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিলে দেখা যায়, পরিত্যক্ত ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পাঠদান চলছিল। বিদ্যালয়ের ছাদ, দেয়াল ও বীমের পলেস্তার খসে পড়ছে। ফাটল। প্রধান শিক্ষক রাজিয়া বেগম বললেন, শিক্ষার্থী ১৫৩ জন। একটি ভবনে শ্রেণীকক্ষও তিনটি। মাঝে মধ্যে ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ে। বৃষ্টি পড়লে তড়িঘড়ি করে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় হতে খোলা আকাশে নিচে বের করে আনিই, নয় তো স্কুল ছুটি দিয়ে দিই। আজো পর্যন্ত সংস্কারের মূখ না দেখা একতলা ভবনটিকে ২০১৩সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। যার ফলে অন্য কোন ভবন না থাকায় বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কক্ষে পাঠদান করাতে হচ্ছে।
এরপর বুধবার উপজেলার রূপসী পাড়া ইউনিয়নে দরদরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেলেই দেখা যায়, তার অবস্থায় একই দশা। প্রধান শিক্ষক খালেদা বেগম জানালেন, ভবনের পিছনে দেয়ালে বড় ধরনে ফাটল।বাতাসে টিন উড়ে গেছে। ধসে আতঙ্কে একটি শ্রেণি কক্ষও তালা মেরে রাখা হয়েছে। অন্য একটি তে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রম চালাচ্ছি। তিনি আরো বলেন, ইউনিয়নে পঞ্চম শ্রেণির পিএসসি (সমাপনী) পরীক্ষার একটি মাত্র কেন্দ্র এটি। ২০১৩ সালে স্কুলভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়।
সরেজমিনে দেখা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলেন, আমাদের স্কুলে ভবনের চারপাশে ফাঁক ফাঁক দেখা যাচ্ছে, মাঝে মধ্যে সেখান হতে ইটের টুকরা পড়ে, বৃষ্টি পড়লে ছাদ থেকে পানি আমাদের উপর পড়ে, বেশি বৃষ্টি হলে আমাদের অনেক ভয় লাগে। তারপরেও আমরা নতুন কিছু শেখার জন্য বিদ্যালয়ে আসি।
লামা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা যতীন্দ্র মোহন মন্ডলও বিষয়টি স্বীকার করলেন। তিনি বৃহস্পতিবার প্রতিবেদককে বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ১০টি বিদ্যালয়ের ভবনগুলোয় প্রায় ২হাজার ৬শত শিক্ষার্থী প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে ক্লাস করছে। অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয়ের তালিকা ইতিপূর্বে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙ্গে জরুরী ভিত্তিতে নতুন ভবন নির্মান করা প্রয়োজন বলে মতামত প্রকাশ করেন এই শিক্ষা কর্মকর্তা।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রিটন কুমার বড়–য়া গত শনিবার প্রতিবেদককে বলেন, জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয় ভবনের তালিকা বান্দরবান জেলা পরিষদ ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। তিনি আশা করছেন, দ্রুত এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।