তালা : সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ব্রিজ স্কুলের ৫ম শ্রেণির ছাত্র সাব্বির হোসেন। এক সময়ে ওর কানে পৌঁছাতো না স্কুলের ঘণ্টা। যে বয়সে হাতে থাকবে বই, কাঁধে থাকবে স্কুল ব্যাগ; সে বয়সে নদীর উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাছ ও কাঁকড়া ধরাসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে সে লিপ্ত ছিল। যে বয়সে হাসি-আনন্দে বেড়ে ওঠার কথা; সে বয়সে হাড়ভাঙা খাটুনির কাজে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে সাব্বির। সকাল-সন্ধ্যা কাজ, রাতে একটু ঘুম। এ যেন ছিল সাব্বিরের নিয়তির লিখন। মাছ ও কাঁকড়া ধরা, বিক্রি করা, ট্রলার বা নৌকা থেকে ঝুঁড়ি ভরে মাছ নামানো সবই পারে সে। এ শিক্ষা নিতে হয়েছে পরিবার ও পেটের প্রয়োজনে। এভাবেই শিশু বয়সে শ্রমের জালে আটকে যায় সাব্বিরের জীবন।
সাব্বির হোসেন জানায়, বাবা-মা ও তিন ভাই মিলে ৫ সদস্যর সংসার তাদের। সে ভাইদের মধ্যে ২য়। বাবা কামরুল ইসলাম সুন্দরবনের মধ্যে মাছ ধরত। আর বড় ভাই কাঁকড়ার পয়েন্টে কাজ করতো। বাবা ও ভাইয়ের আয় দিয়ে মোটামুটি চলতো তাদের সংসার। ২০১৮ সালে তার বাবা সুন্দরবনের মধ্যে মাছ ধরার সময় বনদস্যুর কবলে পড়ে। দুই লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে মুক্তিপন দিয়ে তার বাবাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়। বনদস্যুর নির্যাতনে তার কোমরের হাড় ভেঙ্গে যায়। বাবা হয়ে যায় প্রতিবন্ধি। বড় ভাই ইটভাটার পাশাপশি কাঁকড়ার পয়েন্টে কাজ করে। সেও ভাইয়ের সাথে কাঁকড়ার পয়েন্টে ২৫ টাকা ঘন্টায় কাজ শুরু করে। কলবাড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হয়ে যায় তার। এদিকে কোভিড-১৯ এর কারণে পরিবারের আয় আবারো থেমে যায়। ২০২১ সালে কোভিডের পরিস্থিতি ভালো হলে তারা আবার কাজ শুরু করে। ঠিক এই সময় শ্রমজীবী শিশুদের জন্য বে-সরকারী সংস্থা উত্তরণ তাদের বাড়ির পাশে ব্রিজ স্কুল তৈরী করলে সে ওই স্কুলে ভর্তি হয়। বর্তমানে সে লেখাপড়ার পাশাপাশি কাঁকড়ার পয়েন্টে কাজ করছে। তার ছোট ভাই ব্রিজ স্কুলে ৩য় শ্রেণিতে পড়ে। শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি একজন সফল ব্যবসায়ী হতে চায় সাব্বির।
সাবিবরের বাবা কামরুল ইসলাম জানান, দীর্ঘদিন চিকিৎসার ফলে তিনি এখন মোটামুটি সুস্থ। মাঝে মাঝে মাছ ধরাসহ অন্যান্য কাজও করে থাকেন। দুই ছেলের কঠিন পরিশ্রমের ফলে ঋণের বোঝা অনেকটা হালকা হয়েছে।
তিনি বলেন, সাব্বির লেখাপড়া করে সফল ব্যবসায়ী হতে চায়। তবে ব্যবসা করার জন্য শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। ব্রিজ স্কুলটি দীর্ঘদিন চলুক এবং তাদের সন্তানেরা ভালোভাবে শিক্ষা অর্জন করুক এটাই তাদের কাম্য। সাব্বির আবার শিক্ষামূখী হওয়ার কারণে তারা উত্তরণ ও এডুকোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
উত্তরণের এডুকো প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক নাজমা আক্তার বলেন, শ্যামনগর উপজেলায় বুড়িগোয়ালিনি, গাবুরা, মুন্সিগঞ্জ ও কাশিমাড়ী ইউনিয়নে এডুকো প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই চার টি ইউনিয়নের চারটি ব্রিজ স্কুলে ৩৫০ জন শ্রমজীবী শিশুকে শিক্ষাদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এই শিশুরা নিয়মিত ব্রিজ স্কুলে এসে লেখাপড়া করছে এবং এরমধ্য থেকে ২৫ জন ইন্ডাষ্ট্রিয়াল সুইং মেশিন ও টেইলরিং এবং ২৫ জন ইলেকট্রনিকস ও মোবাইল সার্ভিসিংয়ের বিষয়ে তিন মাসের কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ব্যবসাসহ আত্মকর্মসংস্থানমূলক বিভিন্ন কাজে যুক্ত রয়েছে। সাব্বিরের মতো অনেক ছেলে-মেয়ে পড়াশুনার পাশাপাশি বাড়তি কাজ করে রোজগার করছে।
শ্যামনগর উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ সোহাগ আলম জানান, মূলত ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত স্কুল বহির্ভূত শিশুদের শিক্ষার মূল স্রোতে আনার জন্যই এ ব্যবস্থা। এটি দুর্গম ও পিছিয়ে পড়া উপকূলীয় এলাকায় অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে ইলেকট্রনিকস ও মোবাইল সার্ভিসিং এবং সুইং মেশিন ও টেইলরিং প্রশিক্ষণ একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ বলে মনে করেন তিনি।
বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হাজী নজরুল ইসলাম বলেন, উত্তরণের এডুকো প্রকল্পের এই কার্যক্রম উপকূলীয় এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে। সাব্বিরের মতো অনেকেই পড়ালেখা ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তা কাজে লাগিয়ে কিছু উপার্জন করছে।