চট্টগ্রাম ব্যুরো:চট্টগ্রামের বড় বড় শিল্পপতি, ব্যবসায়ী কোটিপতিদের ক্লাব ‘দি চিটাগাং ক্লাব লিমিটেড’। চট্টগ্রাম নগরীর এস এস খালেদ সড়কে অবস্থিত প্রাচীন এই ক্লাব গত পাঁচ বছরে ১১৫ কোটি টাকার পণ্য ও সেবা বিক্রি এবং ৬০ কোটি টাকা পণ্য ক্রয়ের বিপরীতে ২০ কোটি টাকার বেশি ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেট সরেজমিন তদন্ত করে চট্টগ্রামের বড় এই অভিজাত ক্লাবের ভ্যাট ফাঁকির তথ্য উদঘাটন করেছে।
চট্টগ্রামের কাস্টমস এক্সাইজ এন্ড ভ্যাট কমিশনারেট-এর কমিশনার মো. আকবর হোসেন বুধবার ৭ এপ্রিল এই তথ্য নিশ্চিত হয়ে ভ্যাট ফাঁকির বিষয়ে চিটাগাং ক্লাব কর্তৃপক্ষকে শোকজ করার উদ্যোগ নিয়েছে ভ্যাট কমিশনারেট।
তাদের অনুসন্ধান প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চিটাগাং ক্লাব লিমিটেড বার, ব্যাংকুইট হল, লাউঞ্জ, গেস্ট হাউজ, বেকারিসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা ও পণ্য বিক্রি করে থাকে। ২০১৫-১৬ অর্থ বছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত এই ক্লাবটি ১১৪ কোটি ৮৪ লাখ ৩৮ হাজার ৫২৯ টাকার সেবা সরবরাহ ও পণ্য বিক্রি করেছে, যার বিপরীতে প্রযোজ্য ভ্যাট ১৭ কোটি ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৭৭৩ টাকা।
প্রতিষ্ঠানের দাখিলপত্র (ভ্যাট রিটার্ন) অনুযায়ী, এসময়ে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ মাত্র ৪ কোটি ১৫ লাখ ৭৮ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে। বাকি ১৪ কোটি ৩২ লাখ ৭ হাজার ৬০৮ টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। অপরদিকে একই সময়ে ক্লাবের নিজস্ব বারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৪ কোটি ৮৮ লাখ ৭৪ হাজার ৩৭৬ টাকার মদ সরবরাহ করা হয়েছে, যার বিপরীতে প্রযোজ্য ভ্যাট ৮৭ লাখ ৯৭ হাজার ৩৮৭ টাকা ও সম্পূরক শুল্ক ৯৭ লাখ ৭৪ হাজার ৮৭৫ টাকা।
এছাড়া একই সময় স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদের ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট ৫৫ লাখ ৪৪ হাজার ৪৪৬ টাকা ও সম্পূরক শুল্ক ৬১ লাখ ৬০ হাজার ৪৯৬ টাকা। আমদানি করা মদের ওপর প্রযোজ্য মোট ভ্যাট প্রায় দেড় কোটি টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক এক কোটি ৫৯ লাখ ৩৫ হাজার ৩৭১ টাকা।
প্রতিষ্ঠানের দাখিলপত্র অনুযায়ী, ক্লাবের পক্ষ থেকে মাত্র ৭৯ লাখ ৭৩ হাজার ১৭৮ টাকার সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি ৭৯ লাখ ৬২ হাজার ১৯৩ টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে ক্লাব কর্তৃপক্ষ।
প্রতিবেদন সূত্রে আরও জানা যায়, ভ্যাট আইন অনুযায়ী, লিমিটেড প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বা কেনাকাটার ওপর উৎসে ভ্যাট প্রযোজ্য। প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদন (সিএ রিপোর্ট) অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত চট্টগ্রাম ক্লাব লিমিটেড কর্তৃপক্ষ প্রায় ৬০ কোটি টাকার পণ্য ক্রয় বা ব্যয় করেছে, যার বিপরীতে প্রযোজ্য উৎসে ভ্যাট প্রায় পাঁচ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। কিন্তু ক্লাব কর্তৃপক্ষ এক টাকার উৎসে ভ্যাট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে কর্তন করলে সরকারি কোষাগারে এই অর্থ জমা দেয়নি। এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে চিটাগাং ক্লাব।
ভ্যাট কমিশনারেট এর অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, চিটাগাং ক্লাব পাঁচ বছরে সেবা সরবরাহ ও পণ্য বিক্রির বিপরীতে মোট রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে ১৫ কোটি ১১ লাখ ৬৯ হাজার ৮০১ টাকা টাকা। প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ের বিপরীতে উৎসে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে প্রায় ৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
সেবা সরবরাহ ও পণ্য বিক্রি এবং ব্যয়ের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি সর্ব মোট ২০ কোটি ৪৫ লাখ ৮৮ হাজার ৮২২ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। ফাঁকি দেওয়া ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্কের ওপর ভ্যাট আইন অনুযায়ী দুই শতাংশ জরিমানা আরোপ করা হলে এই অংক আরও বাড়বে বলে এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার মো. আকবর হোসেন জানান, ভ্যাট ফাঁকির বিষয়ে চিটাগাং ক্লাব কর্তৃপক্ষকে দাপ্তরিকভাবে শোকজ করা হবে এবং আনুষ্ঠানিক শুনানীর জন্য ডাকা হবে। পরবর্তীতে জারমানাসহ ফাঁকি দেওয়া ভ্যাট আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
চিটাগাং ক্লাব লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল হক বলেন, ভ্যাট কমিশনারেটের পক্ষ থেকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে তদন্ত পরিচালনা করা হয়। তখন তদন্ত টিমকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে সহায়তা করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে দাপ্তরিকভাবে কিছু জানেন না উল্লেখ করে মঞ্জুরুল হক বলেন, এটি একটি এলিট শ্রেণির ক্লাব। ২০১৫ সালের পূর্বে ক্লাবের সেবার বিপরীতে কোনো ভ্যাট প্রযোজ্য ছিলো না। ভ্যাট আরোপের পর থেকে নিয়মিত নির্ধারিত ভ্যাট পরিশোধ করা হচ্ছে। ভ্যাট কমিশনারেট কর্তৃক ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগটি কোথাও কমিউনিকেশন গ্যাপ’এর কারণে হয়ে থাকতে পারে।