বনমালীর মৃত্যু ঘিরে রহস্য

প্রকাশঃ ২০২৪-০৯-১৪ - ১৩:০৩

হত্যার ঘটনা ধামাচাঁপায় কোটি টাকা খরচের অভিযোগ

খুলনা ব্যুরো: খুলনা রেলষ্টেশনের পদ্মা বানিজ্য ভান্ডারের মালিক বনমালী মন্ডলের মৃত্যু ঘিরে রয়েছে রহস্য। অভিযোগ রয়েছে, ঘোষ ট্রেডার্সের মালিক অমিত ঘোষের প্রতি হিংসার শিকার হয়ে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। আর বনমালীর মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাঁপা দিতে টপ টু বটম প্রায় এক কোটি টাকা খরচ করেছে অমিত ঘোষ।
খুলনা রেলষ্টেশনের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বনমালী মন্ডলের মৃত্যুর পর তার বড় ভাই কেশব মন্ডল একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু আওয়ামীলীগের প্রভাবশালীদের চাপে সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিয়ে ছেলেকে নিয়ে খুলনা ছাড়েন কেশব মন্ডল। আওয়ামীলীগ নেতাদের সাথে অমিত ঘোষের ছিলো গভীর সখ্যতা। যার সুবাদে ব্যবসায়ী সমিতির মাধ্যমে কিছু টাকা পাইয়ে দিয়ে সাদা কাগজে কেশব মন্ডলের স্বাক্ষর রেখে তা দিয়ে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করে অমিত ঘোষ। অনেক পরে যেয়ে কেশব মন্ডল জানতে পারেন যে, মামলা স্থগিত হয়ে গেছে। এদিকে, অমিত ঘোষের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে সরেজমিনে যেয়ে দেখা যায়, কেশব মন্ডলের দায়ের করা মামলার স্বাক্ষী বনমালীর ম্যানেজার হেমন্ত চাকুরী করছেন অমিত ঘোষের আড়তে। বনমালীর মৃত্যুর ঘটনার সাথে জড়িত রয়েছে হেমন্ত বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। আর এ জন্যই হেমন্তকে মোটা অংকের বেতনে চাকুরী দিয়েছে অমিত ঘোষ। বনমালীর ম্যানেজার হেমন্ত বলেন, আমাকে অমিত দাদা চাকুরী দিয়েছেন। বনমালী হত্যা মামলার স্বাক্ষী হয়ে বিবাদীর আড়তে চাকুরী করার বিষয়ে জানতে চাইলে কোন সদোত্তর তিনি দিতে পারেননি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা তার কাছে এসেছিলেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন যে কোন তদন্তকারী কর্মকর্তা তার কাছে আসেননি। প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বনমালী মন্ডল তার হটসএপে ম্যাসেজ করেছিলো। কিন্তু সে ফোনটি পুলিশের কাছে।
ঘটনা সূত্রে, গত বছরের ২৫ শে জুন নিখেঁাজের একদিন পর খুলনা রেলওয়ে পুলিশ বনমালী মন্ডলের লাশ খুলনা রেলওয়ে ইয়ার্ডে খুজে পায়। নিখেঁাজের দিন সন্ধ্যার দিকে বনমালী মন্ডলের হটসএপ থেকে একটি ম্যাসেজ বনমালীর ম্যানেজার হেমন্তর হটসএপে আসে। ম্যাসেজে লেখা ছিলো, বিকাল সাড়ে চারটার পর কারা যেনো তাকে একটা বন্ধ ঘরে আটকে রেখেছে। কারও সাথে আর দেখা নাও হতে পারে। সে বিপদে আছে, বিষয়টি দুলা ভাইকে জানাতে বলেছে বনমালী। পরদিন সকালে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বনমালীর স্ত্রী সীমান্তী মন্ডল অমিত ঘোষকে দায়ী করলেও বর্তমানে সে অমিত ঘোষের পক্ষেই রয়েছে। গত বছরের জুলাইয়ের ২ তারিখ একটি মামলা দায়ের করেন বনমালীর বড় ভাই কেশব মন্ডল। কিন্তু তথ্য সূত্রে দেখা যায়, এক মাস পর আগষ্টের ৮ তারিখ মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন কেশব মন্ডল। খুলনা রেলওয়ে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সূত্রে জানা যায়, ঢাকার পুলিশ হেডকোয়াটার্সের একটি চিঠির মাধ্যমে মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়। পিবিআই মামলাটি তদন্ত করে ৩/৪ মাসের মধ্যে তদন্তের ফাইনাল রিপোর্ট দেয়। আর এদিকে, মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টি কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবে মামলা প্রত্যাহারের কোনো আবেদন করেননি বলে জানান কেশব মন্ডল।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বনমালী মন্ডল বিবাদী অমিত ঘোষের আড়তে প্রায় দশ বছর চাকুরী করেছেন। পরবর্তীতে অমিত ঘোষ নিজের পরিচিত সীমান্তী মন্ডলের সাথে বিয়ে দেন বনমালীকে। বিয়ের পর বনমালী জানতে পারেন যে, তার স্ত্রীর সাথে পূর্ব থেকে অমিত ঘোষের অবৈধ সম্পর্ক ছিলো। আর বিয়ের পর বনমালীর কর্ম ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে সীমান্তী ও অমিত ঘোষের মেলামেশা চলছিলো। এ নিয়ে বনমালী এবং সীমান্তীর প্রায়ই ঝগড়া—বিবাদ লেগেই থাকতো। পরে বনমালী পদ্মা বানিজ্য ভান্ডার নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেন রেলষ্টেশন এলাকায়। নিজ ব্যবসার সুবাদে বনমালী প্রায় সময় বাসাতে থাকাতে বন্ধ হয়ে যায় অমিত এবং বনমালীর মেলামেশা। কিন্তু পারিবারিক কলহ চলতে থাকে। এমনকি বনমালী নিখেঁাজের দিন সীমান্তী মন্ডল তার বড় ভাইয়ের বাসায় ছিলো। সীমান্তী মন্ডলের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনারা এতোদিন কোথায় ছিলেন? আমি এ বিষয়ে কিচ্ছু জানি না। আর এ বিষয়ে আমাকে কেনো জিজ্ঞাসা করছেন? তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক না বলে জানিয়ে দেন।
অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে অমিত ঘোষের মুখোমুখি হলে, তিনি বনমালী মন্ডলের মৃত্যুর ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানান। কারা খুন হয়েছে আর কোন থানায় মামলা হয়েছে , তাও তিনি জানেন না বলে দাবী করেন। তিনি বলেন, আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমার সাথে সীমান্তী মন্ডলের কোন সম্পর্ক নাই। মামলা প্রত্যাহার হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো উকিল জানেন। আমি কিছু জানি না।
বনমালী মন্ডলের একজন স্বজন বলেন, বনমালী মন্ডল আমাদের পরিবারের একজন ছায়া ছিলেন। তার সাথে এমনটা হবে তা আমরা ভাবতেও পারিনি। তার মৃত্যুর আগে অমিত ঘোষের রোসানলে তিনি পড়েন। আলাদা আড়ৎ দেয়ার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে অমিত ঘোষ নানান কৌশলে বনমালী মন্ডলের পিছনে লেগে থাকতো। হেমন্তকে দিয়ে অমিত ঘোষ নিজের চেক ব্যাংককে পাঠিয়ে টাকা তোলার নাটক সাজিয়ে বনমালীকে চোর সাজাতে চেয়েছিলো। আর ব্যবসা বন্ধ করানোর জন্য নানান ধরনের কৌশল করতো। বনমালীর স্ত্রীকেও নানান সময়ে দামী দামী অলংকার এবং শাড়ী উপহার দিতো অমিত। আর তার মৃত্যুর পর অমিত ঘোষ যাবতীয় খরচ দিয়ে সীমান্তী মন্ডলকে খুলনা শহরে রেখেছেন।
বনমালী মন্ডলের ভাই কেশব মন্ডল বলেন, মামলা করার পর নানান ভাবে হুমকির মুখে পড়েছি। সীমান্তী মন্ডল আমাকে মামলা করতে বাধা দিয়েছিলো। কিন্তু আমি তাকে না জানিয়েই মামলা করি। মামলা করলে আমাকে নানান হুমকি দেয় বিবাদীর লোকজন। আমার ছেলে সুন্দরবণ কলেজে পড়ালেখা করতো। হুমকির মুখে পড়ে তাকে আমি গ্রামে এনে এখানকার কলেজে ভর্তি করেছি। তিনি আরো বলেন, আমি মামলা প্রত্যাহারের কোনো আবেদন করিনি। আমাকে দিয়ে একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে রাখে এবং বনমালীর পরিবারের জন্য এককালীন কিছু টাকা দেয় বৈঠকে থাকা প্রভাবশালী কিছু লোকজন। তারা এ নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্যও বলেন। এক প্রকার অসহায় হয়ে তাদরে কথা মেনে নিয়ে আর আদালতে যাইনি। প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, টাকা হলে সব সম্ভব। ময়না তদন্ত রিপোর্ট পরিবর্তনও সম্ভব। যারা এতো কিছু করলো, তাদের দ্বারা সবই সম্ভব। সব জায়গাই অমিত ঘোষ টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করিয়ে রেখেছে।