কামরুল হোসেন মনি, খুলনা : খুলনায় মেডিকেল কলেজ হাসপাপাতাল ও সদর হাসপাতালে জনভোগান্তির চিত্র গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত তুলে ধরা হলেও সেবাপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমছে না। রোগীদের অভিযোগ অনেক চিকিৎসক কারণে-অকারণে তাদের একগাদা টেস্ট করানোর পরামর্শ ও তাদের পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে রোগীকে প্ররোচিত করেন। এছাড়া সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত ওষুধ থাকলেও সেগুলো চিকিৎসকরা রোগীর ব্যবস্থাপত্রে না লিখে তাদের মনোনীত ওষুধ কোম্পানির ওষুধ লিখে থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে কিছু অসাধু চিকিৎসকের দেওয়া টেস্ট ও অতিরিক্ত ওষুধের নেপথ্যে কমিশন বাণিজ্য।
নগরীর খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ভুক্তভোগী রোগীদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য উঠে আসে। চিকিৎসকদের এ রকম কার্যকলাপ বন্ধ না হলে সেবাপ্রার্থীর ভোগান্তি আরও চরম আকার ধারণ করবে।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়শনের (বিএমএ) ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের খুলনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও খুলনা মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডাঃ মেহেদী নেওয়াজ বলেন, অনেক সময় রোগীদের কিছু টেস্ট হাসপাতালে না থাকায় বাইরে থেকে চিকিৎসকরা করার পরামর্শ দেন। সেক্ষেত্রে ওই চিকিৎসক তার মনোনীত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করার জন্য পরামর্শ দিতে পারেন না। এটা অপরাধযোগ্য। চিকিৎসকরা কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নাম উল্লেখ না করে যে কোন মানসম্মত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করার জন্য রোগীকে পরামর্শ দিতে পারেন। তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, হাসপাতালে যে ওষুধ সাপ্লাই আছে, সেই ওষুধ ওই রোগীর জন্য কার্যকর নয়, সেক্ষেত্রে তারা এর হাই পাওয়ার ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন। আমরা এ ক্ষেত্রে তাদেরকে বলেছি, এটা রোগীকে বুঝিয়ে বলার জন্য। হাসপাতালের সাপ্লাই ওষুধ ওই রোগীর ক্ষেত্রে কার্যকর না হলে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে বিভাগীয় প্রধানকে অবহিত করে ওই রোগীর ব্যবস্থাপত্র লেখার জন্য পরামর্শ দিয়েছি। তিনি বলেন, কিছু অসাধু চিকিৎসকের কারণে এ সব এ বিষয়ে আমরা প্রশ্নে সম্মুখিন হই। তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম। যার কারণে দুই-একটা খারাপ হওয়ার কারণে চিকিৎসকদের ভালো জিনিসগুলো ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
গত ১২ জানুয়ারি দৈনিক প্রবাহ পত্রিকায় ‘খুমেক হাসপাতালে ওষুধ কোম্পানি প্রতিনিধিদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ এ টি এম মঞ্জুর মোর্শেদ শনিবার (১৩ জানুয়ারি) মেডিসিন ইউনিট-১ সকালে হঠাৎ রাউন্ডে চলে যান। সেখানে রোগীর দেখার সময় ওষুধ প্রতিনিধিদের উপস্থিতি দেখতে পান। তিনি আসার সাথে সাথে অনেকে ব্যাগ থুয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। এর মধ্যে এক ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিকে এখন ভিজিটের সময় কারণ জানতে চাইলে সে ভুল স্বীকার করে পার পেয়ে যান।
সম্প্রতি এক বৃদ্ধ খুমেক হাসপাতালে মেডিসিন ইউনিট-৩ এর চিকিৎসা সেবা নেন। চিকিৎসকরা তাকে কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য টেস্টের জন্য ব্যবস্থাপত্র প্রদান করেন। তার উল্টো পাশে সন্ধানী ডায়াগনস্টিক সেন্টার উল্লেখ করে, পাশে মোবাইল নম্বরও দিয়ে দেন। হতদরিদ্র ওই রোগী চিকিৎসকের মনোনীত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের যেতে বাধ্য হলেন। এই গেল একটি চিত্র। খুলনা সদর হাসপাতালে কিডনীজনিত কারণে চিকিৎসা করাতে যান বৃদ্ধ ইউনুস (৫৫)। ডিসেম্বর এর শেষে দিকে নগরীর সেতু ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে দেন। সেখান থেকে টেস্টের রিপোর্ট করিয়ে ডাক্তারের কাছে যান। পুনরায় ওই রোগীকে টেস্টের জন্য সিটি ইমেজিং সেন্টার খুলনাতে পাঠান। এছাড়া ওই হাসপাতালের গাইনী বিভাগে গাইনী ডাঃ ফারহানা রোগীদের ডক্টরস ও লিওন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেস্টের জন্য রোগী পাঠাচ্ছেন। আর মেডিসিন বিভাগে সহকারী রেজিস্ট্রার ডাঃ বেনজির আহম্মেদ মোল্লা রোগীদেরকে টেস্টের জন্য সন্ধানীতে পাঠাচ্ছেন। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অধিকাংশ মেডিসিন ইউনিটগুলোতে রোগীদের টেস্টের জন্য তাদের মনোনীত সন্ধানী ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠাচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছে মেডিসিন ইউনিট-৪ এর সহকারী রেজিস্ট্রার ডাঃ স্বরুপ চন্দ্র পোদ্দার তিনি রোগীর টেস্টের জন্য সন্ধানীতে ও হেলথ গার্ডেনে পাঠাচ্ছেন। এছাড়া মেডিসিন ইউনিট-৫, মেডিসিন ইউনিট-১ ও মেডিসিন ইউনিট-২, নিউরো মেডিসিন বিভাগ থেকে রোগীদের প্রয়োজনীয় টেস্টগুলো তাদের মনোনীত সন্ধানী ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পাঠাচ্ছেন। এ বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থা একাধিক রিপোর্ট সংগ্রহ করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালে কিছু অসাধু ডাক্তার টেস্টের নামে কমিশন বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন। যে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে বেশি কমিশন দেবেন সেখানেই রোগীদেরকে টেস্টের জন্য চিকিৎসকরা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। তাদের মনোনীত ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে টেস্ট না করানো হলে রিপোর্ট দেখেন না, রিপোর্ট ছুঁড়ে ফেলা দেওয়ারও নজির রয়েছে। নৈতিক অবক্ষয়ের চক্রে পড়ে একশ্রেণির চিকিৎসক গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন কমিশনের জোয়ারে। তারা এখন সামান্য জ্বর, ঠা-া, কাশির জন্যও ডজন ডজন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা লিখে দিচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালের একশ্রেণির চিকিৎসকের সহায়তায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের যথেচ্ছ টেস্ট-বাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর। ডায়াগনস্টিক প্রতারণার শিকার হচ্ছেন মানুষজন। একাধিকবার অভিযোগ মিললেও প্রতিকার মিলছে না। রোগী তার পছন্দমতো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেই টেস্ট করালে চিকিৎসক সেই রিপোর্ট গ্রহণ করেন না। তিনি তার নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে আবার একই টেস্ট করিয়ে আনতে চাপ দেন। ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টার তাকে কমিশন দেয়। কমিশন নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল চিকিৎসা মেলে। পরীক্ষার ফি বাবদও আদায় করা হচ্ছে ইচ্ছেমাফিক টাকা-পয়সা। একই ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য একেক প্রতিষ্ঠানে ধার্য আছে একেক ধরনের ফি। বেশি টাকা দিয়ে টেস্ট করিয়েও সঠিক রোগ নির্ণয়ের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা।