জয় মহন্ত অলক, ঠাকুরগাঁও : বালিয়াডাঙ্গী, হরিপুর ও রানীশংকৈল উপজেলার কিছু অংশ নিয়ে ঠাকুরগাঁও-২ আসন। দীর্ঘ ৩০ বছর যাবত আসনটি ধরে রেখেছেন আওয়ামীলীগের এমপি দবিরুল ইসলাম। সব নির্বাচনেই এই আসনটিতে আওয়ামীলীগের সাথে প্রতিদ্বন্দীতা করেছেন জামায়াত। জামায়াতের অনেক জনপ্রিয়তা সত্বেও কখনও নির্বাচিত হতে পারেনি। কিন্তু আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে সাধারণ ভোটারসহ আওয়ামীলীগের তৃনমূল কর্মীরা প্রার্থীতা পরিবর্তন দেখতে চায়। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সম্ভ্যাব্য প্রার্থীরা নানা ভাবে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। নতুন সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে ব্যক্তি ইমেজ ও জনপ্রিয়তায় এগিয়ে রয়েছেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রবীর কুমার রায়।
অনেকটাই ইমেজ সংকটে ভুগছেন ছয় ছয় বার নির্বাচিত এমপি দবিরুল ইসলাম। দবিরুল ইসলামের নির্বাচনী মাঠে এমন অবস্থান বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান প্রবীর কুমার রায়ের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে গেছে।
অন্যদিকে মনোনয়ন পেতে জোরালো জনসংযোগ চালাচ্ছেন ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক আলম টুলুও। এছাড়া মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে দবিরুলের বড় ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম সুজন।
ঠাকুরগাঁও-২ আসনের বিভিন্ন আওয়ামীলীগ কর্মী ও সাধারণ ভোটারদের মাঝে কথা বলে জানা গেছে, দবিরুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে এ এলাকার এমপি। একই সঙ্গে তিনি ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি। ঠাকুরগাঁও-২ আসনের বিভিন্ন সাংগঠনিক পদে পরিবারের সদস্যদের বসানোর কারণে অনেকটাই প্রভাব বিস্তার করে রেখেছেন দবিরুল ইসলাম।
বালিয়াডাঙ্গী ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও যুবলীগের বড় পদগুলো তার পরিবারের সদস্যদের হাতে। এছাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান তার ভাই-ভাতিজা। ছেলে সুজন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। যদিও এগুলোকে জনগণের ভালোবাসা মনে করেন দবিরুল ইসলাম।
তার সমর্থকদের দাবি, তিনি মরে গেলে নেত্রী (শেখ হাসিনা) তার পরিবারের সদস্যদের যে কেউ মনোনয়ন দেবেন, অন্য কাউকে নয়।
এই আসনের জনগণের সঙ্গে কথা বলে দবিরুলের পরিবারতন্ত্রের জিম্মিদশা থেকে মুক্তি চাওয়ার আভাস পাওয়া গেছে। অনেকেই সামনের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নতুন নেতৃত্ব চান।
হরিপুর এলাকার সমশের আলী বলেন, সবাই আওয়ামীলীগে নেতৃত্বে পরিবর্তন চান। তবে ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারেন না। এবার আওয়ামী লীগ থেকে সেক্রেটারি প্রবীর কুমার মনোনয়ন পেতে পারেন। তিনি ভালো লোক। হিন্দু-মুসলমান অনেকেই তাকে চায়।
দবিরুল ইসলাম দীর্ঘদিন এ আসনে এমপি। তবে তার আর্থিক উত্থান ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর। ঠাকুরগাঁও-২ আসনে তার নির্বাচনী এলাকা বালিয়াডাঙ্গীতে রয়েছে তার বিশাল টি এস্টেট। পাড়িয়া ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী রামনগর টি এস্টেট একশ’ একরেরও বেশি জমিতে বিস্তৃৃত। যার বেশির ভাগ সংখ্যালঘুদের বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। দবিরুল ইসলাম এসব জমি অল্প টাকায় তাদের কাছ থেকে কিনেছেন, বা জোর করে দখল করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
পাড়িয়া ইউনিয়নের কদমতলী গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, সংখ্যালঘুরা হচ্ছে আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক। তারা মনে করে, অন্য দলে ওরা কোনো দিনও ভোট দেবে না, তাই নির্বাচনের আগে ভালো কথা বললেও নির্বাচনের পর অত্যাচার নির্যাতন করে। দবিরুল ইসলামও আমার সাথে এমন করেছেন। আমি তার কাছে গিয়ে কান্না করেছি। তিনি বলেছেন, কোথাও কোনো জমি দখল হচ্ছে না।
কিন্তু নির্যাতিত হওয়ার কারণে সংখ্যালঘুরা অনেকটাই অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রবীর কুমার ও মোস্তাক আলম টুলুর দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। দবিরুল ইসলামের পরিবর্তে তারা আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নতুন কোন আওয়ামীলীগের প্রার্থীকে চান।
প্রবীর কুমার বলেন, নেত্রী (শেখ হাসিনা) যাকে মনোনয়ন দেবেন তার পেছনে কাজ করবো। তবে এলাকার প্রকৃত চিত্র যদি জানতে পারেন, তাহলে আমাকে নেত্রী মনোনয়ন দেবেন বলে আমার বিশ্বাস।
তিনি বলেন, দবিরুল ইসলামের বয়স হয়েছে। চা বাগানকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়েছেন। তাই উনি আবার দাঁড়ালে ভোটে প্রভাব পড়বে। সব মিলিয়ে ঠাকুরগাঁও-২ আসনে নৌকা মার্কাকে বিজয়ী করতে হবে। এ আসনের প্রতিটি কমিটি তিনি কুক্ষিগত করে রেখেছেন। পুরো জিম্মি আমরা। আমাকে মনোনয়ন না দিলে অন্য ভাল ইমেজের প্রার্থীকে মনোনয়ন দিলে নৌকা জয়ী হবে। এছাড়া নেত্রীর কথার বাইরে আমরা কেউ যাব না।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, নেত্রী সবকিছু বিবেচনা করেই আগের প্রার্থীকেই মনোনয় দিবেন। না হলে আসনটি হারাতে হবে। এছাড়া যারা মনোনয়ন চাচ্ছেচন তারা ভোট পাবেন না। সংখ্যালঘু নিয়ে আমার ভাই দবিরুল ইসলামের নামে যে রটনা তা প্রতিপক্ষ ঘটিয়েছে। আমাদের পরিবারের পেছনে অনেক শত্রু রয়েছে।
সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশী অ্যাড.মোস্তাক আলম টুলু জানান, এই আসনের মানুষ নতুন মুখ চায় আওয়ামীলীগ।
বর্তমান এমপি দবিরুল ইসলাম জানান, দীর্ঘদিন যাবত জনপ্রিয়তার কারণে জনগনই আমাকে ছয় ছয় বার এমপি বানিয়েছেন। এলাকায় যেমন উন্নয়ন করেছি তা দেশের কোন নির্বাচনী এলাকায় হয়নি। মনোনয়ন এবারো পেলে জনগনই আমাকে নির্বাচিত করছে। তবে দেশনেত্রীর সিদ্ধান্ত যা দিবে তাই মেনে নিব।
অপর দিকে আওয়ামী লীগের সাথে দীর্ঘ প্রতিদ্বন্বীতা করে আসছেন ঠাকুরগাঁও জেলা জামায়াতের আমি মাওলানা আব্দুল হামিদ। তিনি জনপ্রিয়তার কারণে প্রতিবারেই কম ভোটে হেরেছেন দবিরুল ইসলামের কাছে।
জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা আব্দুল হাকিম জানান, র্দীর্ঘদিন এমপি দবিরুলের সাথে নির্বাচন করে হেরেছি খুব কম ভোটে। জোট থেকে মনোনয়ন না দিলে দরকার হলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবো।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা জেড মূতুর্জা তুলা জানান, এই আসনের মানুষ পরিবর্তন চায়। আওয়ামী লীগের বর্ত মান ইমেজ অনেক কারণে নষ্ট। দলের মধ্যেই বিবেদ সৃষ্টি হয়েছে। তাই সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এলাকায় গনসংযোগ ও তৃনমূল নেতাকর্মীদের সাথে দলকে সুসংগঠিত করার কাজ করছি। নির্বাচনে দল থেকে মনোনয়ন পেলেই আমি নিশ্চই নির্বাচিত হবো।
অন্যদিকে জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী এমপি দবিরুল ইসলামের ভাগিনী জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি নুরুন নাহার বেগম। তিনি এলাকায় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে অনেকেই জানিয়েছেন।