ফারুক হোসেন, সাঁথিয়া (পাবনা) : বাঘাবাড়ী নৌবন্দর চ্যানেল যমুনা নদীতে নাব্যতা সঙ্কট এখনো কাটেনি। ফলে বন্দরের আমদানি-রফতানি অর্ধেকে নেমে এসেছে। নৌবন্দরের ৩০ কিলোমিটার ভাটিতে নগরবাড়ী এলাকায় নাব্যতা সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারন করার ফলে জাহাজ থেকে জ্বালানী তেল, রাসায়নিক সারসহ বিভিন্ন পণ্য লাইটারেজ করে বাঘাবাড়ী বন্দরে আনা হচ্ছে। আমদানীর তুলনায় চাহিদা বেশি হওয়ায় অয়েল ডিপোর আপদকালীন মজুদ থেকে জ্বালানী তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে আপদকালীন মজুদ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এদিকে বিআইডাব্লিউটিএ নৌচ্যানেল সচল রাখতে ড্রেজিং করে পলিমাটি নদীতেই ফেলছে। ¯্রােতের টানে পলিমাটি ভাটিতে জমে আবারো ডুবো চর জেগে উঠছে। এতে নাব্যতা সঙ্কট দুর না হয়ে আরো তীব্র হচ্ছে বলে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
বাঘাবাড়ী বন্দরের সহকারী পরিচালক এস এম সাজ্জাদুর রহমান জানান, দৌলতদিয়া-বাঘাবাড়ী নৌপথে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় জ্বালানী তেল, রাসায়নিক সারসহ অন্যান্য মালামাল পরিবহনের একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মাধ্যম। এ নৌপথে জ্বালানী তেলবাহী ট্যাংকার, রাসায়নিক সার ও বিভিন্ন পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ চলাচল করে। বাঘাবাড়ী বন্দর থেকে উত্তরাঞ্চলে চাহিদার ৯০ ভাগ জ্বলানী তেল ও রাসায়নিক সার সরবরাহ করা হয়। আবার উত্তরাঞ্চল থেকে বাঘাবাড়ী বন্দরের মাধ্যমে চাল ও গমসহ অন্যান্য পণ্যসামগ্রী রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। নাব্যতা সঙ্কটে বন্দরে আমদানি রফতানি অর্ধেকৈ নেমে এসেছে। এ নৌ চ্যানেলের নগরবাড়ী পয়েন্টে নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিআইডাব্লিউটিএ নৌ চ্যানেলের নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য ড্রেজিং কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
জানা যায়, বাঘাবাড়ী বন্দর নৌ-চ্যানেল যমুনা নদীতে গত ডিসেম্বরের শুরু থেকে নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বর্তমানে এই সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারন করেছে। জ্বালানী তেল ও পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের জন্য পানির গভীরতা প্রয়োজন ১০ থেকে ১১ ফুট। বাঘাবাড়ী বন্দরের ৩০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে কোথাও কোথাও পানির গভীরতা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫ থেকে ৬ ফুট। বিপিসি সূত্র জানা যায়, নভেম্বর মাসে ১০ লাখ লিটার জ্বালানী তেল নিয়ে জাহাজ বাঘাবাড়ী বন্দরে ভীড়েছে। ডিসেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছিল ৭ লাখ লিটারে। নাব্যতা সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করায় চলতি জানুয়ারি মাসের ৬ তারিখ থেকে ১৫ পর্যন্ত বাঘাবাড়ী নৌচ্যানেলে জাহাজ বন্ধ ছিল। গত ১৬ জানুয়ারি থেকে বন্দরের ৩০ কিলোমিটার ভাটি নগরবাড়ীতে লাইটারেজ করে ও আন্ডারলোড নিয়ে জাহাজ বাঘাবাড়ী বন্দরে ভীড়ছে। এ কারণে বন্দরে জ্বালানী তেলসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি রফতানি অর্ধেকে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার ডিষ্টিবিউটর এজেন্ট অ্যান্ড পেট্রোল পাম্প ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ জাকির হোসেন বলেন, উত্তরাঞ্চলে প্রায় ৫ শতাধিক পেট্রোল পাম্প, ৩ শতাধিক ডিলার এবং ৫টি ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে। নাব্যতা সঙ্কটে আন্ডারলোড নিয়ে জ্বালানী তেলবাহী জাহাজ বাঘাবাড়ী বন্দরে ভীড়ছে। তিনটি কোম্পানিতে প্রতিদিন রিসিভ হচ্ছে মাত্র ১৬ লাখ লিটার জ্বালানী তেল। সেচ মওসুমে বাঘাবাড়ীর ডিপোর পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা এই তিনটি কোম্পানি থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩৬ লাখ লিটার জ্বালানী তেল সরবরাহ করা হয়। প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার এই চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪৫ লাখ লিটারে। প্রতিদিনের ঘাটতি প্রায় ২০ লাখ লিটার পুরণ করা হচ্ছে আপদকালীন মজুদ থেকে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি উত্তরাঞ্চলে জ্বালানী সঙ্কট দেখা দেবে। এতে সেচনির্ভর বোরো আবাদে এবং বিদু্যুৎ উৎপাদনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বিসিআইসির বাঘাবাড়ি বন্দরের বাফার গুদাম ইনচার্জ মোঃ সোলায়মান হোসেন বলেন, বাঘাবাড়ী বন্দর রাসায়নিক সার পরিবহনের ট্রানজিট পয়েন্টে। সেখান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার বস্তা রাসায়নিক সার সড়ক পথে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ১৪টি বাফার গুদামে সরবরাহ করা হয়। যমুনা নদীর নাব্যতা সঙ্কটে রাসায়নিক সারভর্তি পূর্ণলোড নিয়ে বাঘাবাড়ী বন্দরে ভিরতে পারছে না। বন্দরের ৩০-৩৫ কিলোমিটার ভাটি জাহাজ থেকে সার ছোট ছোট নৌকায় লাইটারেজ করে বাঘাবাড়ীতে নিয়ে আসা হচ্ছে। এতে বাফার গুদামগুলোতে আপদকালীন সারের মজুদ গড়ে তোলার কাজ চরমভাবে বিঘিœত হচ্ছে। এছাড়া পরিবহন ব্যয় জাহাজ প্রতি ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা বেড়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা বাঘাবাড়ী বন্দরের মাধ্যমে পণ্যসমাগ্রী আমদানি রফতানিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাবনা হাইড্রোলজি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ব্রক্ষপুত্র ও তিস্তা নদীর প্রবাহ একসঙ্গে ধারন করে বিশাল জলরাশি নিয়ে যমুনা নদী বির্স্তীর্ণ জনপদের ভেতর দিয়ে প্রবাহমান। সেচ মওসুমে ভারত তিস্তা ও ব্রক্ষপুত্র নদের পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পানি প্রবাহ অনেক কমে গেছে। এর বিরুপ প্রভাব পড়েছে যমুনা নদীতে। ফলে যমুনায় নাব্যতা সঙ্কট প্রকট আকার ধারন করেছে। ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ কমায় যমুনার নাব্যতা সঙ্কট আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএ আরিচা অফিসের একটি সূত্রে জানা যায়, রাসায়নিক সার ও পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের জন্য ১০ থেকে ১১ ফুট পানির গভীরতা প্রয়োজন হয়। সেখানে এই নৌ চ্যানেলের নগরবাড়ীর উজানে আধা কিলোমিটা এলাকায় পানির গভীরতা রয়েছে মাত্র ৪ থেকে ৫ ফুট। নৌ-চ্যানেলের ওই পয়েন্ট চরের পরিধি বেড়ে গেছে। কমে গেছে পানির গভীরতা। প্রতিদিন পদ্মা-যমুনা নদীতে পানি কমা এবং বালির প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় নাব্যতা সঙ্কট আরো প্রকট আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তারা।
বিআইডাব্লি¬উটিএ আরিচা অফিসের যুগ্ন পরিচালক মোঃ আব্দুস ছালাম জানান, প্রতি বছর এসময় দৌলতদিয়া-বাঘাবাড়ী নৌচ্যানেলে নাব্যতা সঙ্কট দেখা দেয়। নগরবাড়ীর উজানে ৫ থেকে ৬ ফুট পানির গভীরতা রয়েছে। পদ্মা ও যমুনা নদীতে প্রতিদিন পানি কমছে। উত্তরাঞ্চলে জ্বালানীতেল ও রাসায়নিক সার সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য বিআইডাব্লিউটিএ কাজ করে যাচ্ছে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাত এই নৌ-চ্যানেল সচল রাখার জন্য নগরবাড়ীর উজানে দু’টি ড্রেজার পলি অপসারন করছে। এদিকে বালির প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় ড্রেজিং করার পর ভাটিতে পলি পড়ে ডুবোচরগুলো আগের স্থানে ফিরে যাচ্ছে। ড্রেজিং করে পলিমাটি নদীতে ফেলায় এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এতে শুধু টাকার অপচয় ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না বলে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
বিপিসি’র বাঘাবাড়ী রিভারাইন অয়েল ডিপোর যমুনা কোম্পানির ম্যানেজার এ, কে, এম জাহিদ সরোয়ার জানান, বাঘাবাড়ীতে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তিনটি তেল কোম্পানির ডিপোতে ৪ কোটি ২৫ লাখ লিটার ডিজেল মজুদ আছে। নাব্যতা সঙ্কটে লাইটারেজ করে এবং আন্ডারলোড নিয়ে প্রতিটি জাহাজ ৩ থেকে ৪ লাখ লিটার জ্বালানী তেল নিয়ে বাঘাবাড়ী বন্দরে ভিড়ছে। তিনটি কোম্পানিতে গড়ে প্রতিদিন ১৬ থেকে ১৮ লাখ লিটার জ্বালানী তেল রিসিভ হচ্ছে। সেচ মওসুমে গড়ে প্রতিদিন সরবরাহ করা হচ্ছে ৩৬ লাখ লিটার। প্রতিদিনের ঘাটতি পুরণ করা হচ্ছে আপদকালীন মজুদ থেকে। এতে আপদকালীন মজুদ ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।