গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি : গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে ভাল নেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা। কেউ তাদের খোঁজ-খবর রাখে না। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মানুষেরা রয়েছে সরকারের দৃষ্টির অন্তরালে। সরকার যায়, সরকার আসে। কিন্ত ক্ষুদ্র এ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। ফলে স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর আজও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠি স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবহেলিত এবং পিছিয়ে রয়েছে।
এ সব ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠি পরিবারের সদস্যরা অর্ধহারে, অনাহারে, অভাব-অনটন, রোগ-শোকসহ নানা সংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছে। অভাব-অনটন, দুঃখ-দূর্দশা আর হতাশাই যেন এ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পল্লীর মানুষের নিত্য দিনের সঙ্গী।
গোপালগঞ্জ জেলার একমাত্র কাশিয়ানী উপজেলার বিশ্বনাথপুর, ব্যাসপুর ও মিরারচর গ্রামে ৫৮ টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের বসবাস রয়েছে। যারা স্থানীয় ভাবে ‘বুনো’ সম্প্রদায় নামে পরিচিত। এদের মধ্যে ৭০ ভাগ পরিবার দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করছে। শিক্ষায় পশ্চাৎপদতার কারণে তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকান্ডে থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে ভারতের নাগারল্যান্ড রাজ্যের নাগদপুরের মালো সম্প্রদায়ের শতাধিক লোক কাশিয়ানীতে আসেন। লর্ড ডালহৌসির আমলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নীল চাষের সম্প্রসারণের জন্য তাদের কাশিয়ানীতে নিয়ে আসে। তারা উপজেলার ব্যাসপুর, বিশ্বনাথপুর ও মিরারচর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। ১৯৪৭ সালে অনেকেই দেশ ত্যাগ করে নিজ ভূমিতে ফিরে যান। এখনও কাশিয়ানীর ওই সব গ্রামে ৫৮টি পরিবার বসবাস করছে। যারা দারিদ্রতার কষাঘাতে অতি কষ্টে দিন কাটাচ্ছে।
সরেজমিনে উপজেলার বিশ্বনাথপুর গ্রামের গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ পরিবার নানা সমস্যায় জর্জরিত। পাটখড়ি আর পলিথিন ছাউনী দিয়ে তৈরী দোচালা ছাপড়া ঘরে রাতের বেলা কোন মতে মাথা গোঁজার চেষ্টা করছে। নেই কোন স্বাস্থ্য সম্মত ল্যাটিন, বিশুদ্ধ পানিসহ অন্যান্য নাগরিক সুযোগ সুবিধা। এ পল্লীতে লাগেনি কোন আধুনিকতার ছোঁয়া।
ওই গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে জীর্ণশীর্ণ দেহ নিয়ে পলিথিনের তৈরী ছাপড়ার সামনে বসে আছে এক নারী। কাছে গিয়ে নাম জানতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। নাম বাসন্তি কর্মকার (৪০)। চার বছর আগে স্বামী মারা গেছে। অন্যের জায়গায় পাটখড়ি ও পলিথিনের ছাউনী দিয়ে বসবাস করছে। অন্যের জমিতে শ্রম বিক্রি করে যা পায় তা দিয়ে কোন মতে ছোট দু’টি সন্তান নিয়ে চলে তার সংসার।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের অবসর প্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক দুলাল কর্মকার জানান, তাদের মধ্যে অনেকের জমি বেদখল হয়ে গেছে। শিক্ষা না থাকায় ও সংগঠিত না হওয়ায় তারা বুঝতে পারছে না। তারা আইনী সহায়তা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। এদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৯০ জনের কোন জমিজমা নেই। অনেকের কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে জমি নেই।
এ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির মানুষেরা খুব সহজ সরল ও সাদাসিধে জীবন যাপন করে। এ সুযোগে স্থানীয় ভূমিদস্যুরা তাদের অনেক জমা-জমি দখল করে নিয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। ফলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা এক সময় এ অঞ্চলের জমিদার থাকলেও এখন দিন মজুর আর ভূমিহীনে পরিণত হয়েছে। পথে বসেছেন অনেকে। অনেকে মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে জড়িয়ে পড়ছে ঋণের জালে। আবার অনেকে অত্যাচারিত হয়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন।
এ জনগোষ্ঠির নারী-পুরুষেরা জঙ্গলে ঘুরে এক সময় বেজী, ইঁদুর, পাখি, খরগোশ, কচ্ছপসহ নানা ধরণের প্রাণি শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো। এখন বন-জঙ্গল উজাড় হয়ে যাওয়ায় তাদের জীবিকাও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বর্তমান দিনমজুর, ইটভাঙ্গা, সেলুন, রাজমিস্ত্রী, কাঠমিস্ত্রী ও গাড়োয়ানের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সুবল কর্মকার বলেন, এতো সংকটের মধ্যেও আমরা আমাদের সংস্কৃতি লালন পালন করে চলেছি। আমাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব কালীপুজা ও মনসা পূজা। নিজেদের মধ্যে বিয়ে সাদি সম্পন্ন হচ্ছে।
কাশিয়ানী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠি কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বিষ্ণুপদ কর্মকার বলেন, স্বাধীনতার ৪৪ বছরে দেশের অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন হয়নি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির ভাগ্য। আমরা রয়েছি সরকারের সুদৃষ্টির অন্তরালে।
বিশ্বনাথপুর গ্রামে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের একমাত্র উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র শ্যামল কর্মকার জানায়, এখানকার শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করলেও অর্থনৈতিক কারণে মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যন্ত যেতে পারে না। সে আরো জানায়, শিক্ষার অভাবে ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া ছেড়ে শিশু শ্রমে জড়িয়ে পড়ে।
কাশিয়ানী উপজেলার ব্যাসপুর-বিশ্বনাথপুর আদিবাসী বহুমুখী কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি দুলাল চন্দ্র কর্মকার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ইউএনও মাহাবুবুর রহমান থাকা কালে কয়েকটি পরিবারকে টিউবওয়েল, ল্যাটিন, ও গরু বিতরণ করলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। কিন্তু এখন আর কেউ তাদের খোঁজ-খবর নেয় না। তিনি আরো বলেন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ভিজিডি, ভিজিএফ, বয়স্কভাতাসহ অন্যান্য সরকারি সুবিধাও দেয়া হয় না।
একই গ্রামের সুকুমার কর্মকার জানান, স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৫ বছরেও আমাদের জন্য কোন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়নী। ফলে আমরা প্রতিনিয়ত অভাবের সাথে যুদ্ধ করে টিকে আছি। আমাদের দুঃখ-কষ্টের শেষ নেই।
মহেশপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ কাজী আবুল কালাম আজাদ বলেন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর যারা বয়স্ক ও বিধবা ভাতা পাচ্ছে না তাদের ভাতার আওতায় আনা হবে।