স্বাধীনতা দিবস এলেই বটিয়াঘাটার নারায়ন-ভক্তিরাণী হয় অশ্রুসিক্ত

প্রকাশঃ ২০২৩-০৩-২৬ - ১১:২৯

খুলনা : স্বাধীনতা দিবস এলেই খুলনার বটিয়াঘাটায় শত পরিবারে দেখা দেয় দীর্ঘশ^াস। অনেকেই অতিতের স্মৃতি রোমান্থন করে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। চুকনগরের গণহত্যার স্মৃতি আজও বেঁচে থাকা স্বজনদের কাঁদায়। খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার শতাধিক মানুষ পাকসেনাদের হাতে নির্মম ভাবে শহীদ হন। সে হত্যাকান্ডের মধ্য থেকে বেঁচে যাওয়া স্বজনদের চোখে আজও বেদনার অশ্রু এ দিনে ঝরে পড়ে। ১৯৭১ সালের মে মাসে চারিদিকে যখন লুটপাট, অগ্নি সংযোগ আর গোলা গুলি শুরু হয়েছে। তখন বটিয়াঘাটার বসুরাবাদ গ্রামের ধনাঢ্য সুরেন্দ্রনাথ বাছাড় ভিত হয়ে পড়েন। বড় ছেলে নারায়ন চন্দ্র বাছাড় এবং পুত্রবধু ভক্তিরানী বাছাড়কে পালাতে বলেন। কথা হয় ডুমুরিয়া যেয়ে দেখা হবে। ১৮ মে সকালে বাড়ী ছেড়ে পালালেন সুরেন্দ্রনাথ বাছাড়। কিসমত ফুলতলা গ্রামের জোদ্দার বাড়ির কাছে এলে রাস্তায় লোকজন দেখে হোগলাবাগানের ভিতর লুকালেন। তখন কাজীবাচা নদীর পূর্বপারের কয়েক জন লোক তাকে দেখে ফেলেন। হাতে থাকা একটি ব্যাগের মধ্যে রাখা স্বর্ণালংকার আর বেশ কিছু নগদ টাকা তারা কেড়ে নিয়ে যায়। পরে ১৯ মে সকালে ডুমুরিয়া থেকে একটি নৌকা যোগে স্বপরিবারে চুকনগরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সন্ধ্যার দিকে হাজার হাজার নৌকার সাথে তারাও ভদ্রা নদী দিয়ে চুকনগরের কাছে আসেন। এ সময় তাদের নৌকা ডুবি হয়। ভক্তিরাণীর বয়স তখন সতের বছর হবে। কোলে থাকা তিন বছরের শিশু পুত্র শিমুল কোল থেকে পানিতে হারিয়ে যায়। ভক্তিরানী নদীতে সাঁতার কেটে কাঁদছে আর শিশুটিকে খুঁজছে। স্বামী নারায়ন চন্দ্র আর শশুর সুরেন্দ্রনাথ কে কোথায় গেছে তার কোন খোঁজ নেই। ভক্তি একটি নৌকার হাল ধরে ওঠার চেষ্টা করলে তারা ফেলে দেয়। পরে অন্য একটি নৌকার মানুষ তার হাত ধরে টেনে তোলেন। এসময় কে যেন চিৎকার করে বলতে থাকে একটা বাচ্চা পাওয়া গেছে। তখন ভক্তি দ্রুত ছুটে যেয়ে দেখেন তার কোলের শিশু।

সে রাতে নৌকা থেকে নেমে নদী তীরে হাজারও মানুষের সাথে রান্না সেরে বসে থাকেন। রাত পোহাবার আশায়। ২০ মে সকালে তারা জানতে পারেন এখনে আজ পাক বাহিনীর লোকেরা আসবে। তাই যে যার মত দিক বিদিক ছুটে পালাচ্ছে। ভক্তি রানী এবং তার স্বামী নারায়ন ছুটে কিছুদুর যেয়ে একটা ভ্রাম্যন বাড়ির কাছে পৌঁছায়। ওই বাড়িতে ভ্রাম্যণরা স্বামী স্ত্রী দু’জনে বসবাস করেন। কোন ছেলে মেয়ে নেই। ভক্তিরাণী বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অনুনয় বিনয় করে বলেন, আমাদের খুবই বিপদ একটু থাকতে দেন। ভ্রাম্যণের স্ত্রী ঘরে বসেই বলেন, আমাদের বাড়ির চারিদিকে মুসলমানরা বাস করে। তোমাদের থাকতে দিলে আমাদের সমস্যা হতে পারে। তার চেয়ে তোমারা বাড়ির পিছনে পাট গাছের মধ্যে লুকিয়ে থাক।

ভক্তিরণী বলেন, তখন সবে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। শিশু বাচ্চা নিয়ে প্রায় সারা দিন না খেয়ে সবাই ঝিমিয়ে পড়েছি। ভাবলাম রাত টুকু পাট ক্ষেতের মধ্যেই থাকব। ওদিকে সেই সকাল থেকেই গুলি শুরু হয়েছে। এখন কিছুটা থেমেছে। আমার শ্বশুর সুরেন্দ্রনাথ বাছাড় কোথায় আছেন জানিনা। মনটা খুবই খারাপ লাগতে থাকে। ছুটে পালাবার সময় কে যে কোথায় গিয়েছে কিছুই জানিনা। রাত প্রায় আটটা সাড়ে আটটার দিকে আমাদের এক নিকট আত্মীয় খুঁজতে খুঁজতে পাট বাগানের কাছে এসে আমার নাম ধরে ডাকতে থাকে। আমি গলার শব্দ শুনে চিনতে পারি। তাকে পাট বাগানে আসতে বলি। কাছে এসে বলে তোমার শ্বশুর মারা গেছে। কথা গুলো বলতে বলতে ভক্তি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

এ সময় পাশে বসে থাকা নারায়ণ চন্দ্র বাছাড় বলেন, পরের দিন ভোরে আমি ঘটনা স্থলে যাই। একটি শুকনো পুকুরের ভিতর দু’থেকে আড়াইশ’ মানুষ পালিয়ে ছিল। সেখানে এসে পাকসেনারা ব্র্যাস ফায়ার করে। শুকনো পুকুর রক্তে ভিজে উঠেছে। এত সব লাশের মধ্যেও বাবাকে চিনতে পেরেছিলাম। কিন্তু আর কিছুই করার নেই। ফিরে গেলাম পাট বাগানের কাছে। সেখান থেকে সবাই মিলে অন্যান্যদের সাথে পালিয়ে ভারতে চলে গেলাম। কত যে লোক সেদিন ওই চুকনগরে মারা গিয়েছিল তার হিসাব আজ আর আমার মনে নেই। বছর ঘুরে চুকনগরের সেই গণহত্যার দিন এলে আজও চোখ ফেঁটে জল আসে।

২০ মে বৃহস্পতিবার চুগনগরের গণহত্যায় বটিয়াঘাটা উপজেলার যারা মারা গিয়েছিলেন তার মধ্যে ৯৮ জনের পরিচয় পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে জলমা ইউনিয়নে ১৫ জন। তারা হলেন অবিনাশ  গাইন, অমর গাইন, রণজিৎ গাইন, ইশ্বরচন্দ্র গাইন, বিনয় গাইন, সৌরভী গাইন, অধর মন্ডল, ধীরেন মন্ডল, খগেন মন্ডল, নিরঞ্জন মন্ডল, অরবিন্দ রায়, বেলকা মল্লিক, দয়াল ঢালী, সুবল গোলদার, সুধন্য মন্ডল।

বটিয়াঘাটা ইউনিয়নের যে ৩৭ জন চুকনগরে মারা যান তারা হলেন, সতীশ চন্দ্র বৈরাগী, সুরেন্দ্রনাথ বাছাড়, গৌরপদ বিশ্বাস, মুকুল রায়, নিতাই রায়, রাধাকান্ত রায়, সুধীর রায়, হরিদাস রায়, প্রভাস মন্ডল, রামচরণ মহালদার, সুশীল সানা, খগেন্দ্রনাথ সরকার, রসিক সরকার, তারাপদ ফৌজদার, মনু সরকার, সুধীর ফৌজদার, অধীর ফৌজদার, সন্নাসী বালা, চুনীরাণী বালা, দিনবন্ধু বালা, জিতেন বৈরাগী, কিরণ বৈরাগী, চারু বৈরাগী, শিবে বৈরাগী, পুলিন বৈরাগী, সুধীর বৈরাগী, নগেন বৈরাগী, কৃষ্ণপদ বৈরাগী, রুক্ষিনী বৈরাগী, বিরাজ মিস্ত্রী, নকুল সরকার, সন্নাসী বালা, দীনবন্ধু বালা, আনারতী বালা, টুনি বালা, অক্ষয় মন্ডল, পাঁচু মন্ডল।

গঙ্গারামপুর ইউনিয়নের ৪২ জন মানুষ মারা যান। তাদের মধ্যে ছিলেন, শুরুদাস রায়, লক্ষীকান্ত রায়, রমেশ রায়, কৃষ্ণপদ রায়, অধীর জোদ্দার, হরিপদ জোদ্দার, মহেন্দ্র জোদ্দার,  গুরুদাস জোদ্দার, কালিপদ রায় , দীনবন্ধু রায়, রামচন্দ্র জোদ্দার, মনোজ জোদ্দার, নিরঞ্জন জোদ্দার নিরু, চিত্তজোদ্দার, বিমল জোদ্দার, বিনয়কৃষ্ণ জোদ্দার, জ্ঞান জোদ্দার, অমল জোদ্দার, প্রফুল্ল বিশ্বাস, ললিত জোদ্দার, জগন্নাথ মন্ডল, নরেন মন্ডল, হরিভক্ত মন্ডল, পবন মন্ডল, বৈদ্যনাথ রায়, খোকন রায়, মনোরঞ্জন জোদ্দার, কৃষ্ণপদ জোদ্দার, অভয়চরণ জোদ্দার, মহাদেব মহালদার, কালি মহালদার, মনো জোদ্দার, খোকন জোদ্দার, শিবপদ ঢালী, বিনোদ মন্ডল, ভক্তরাম মন্ডল, অতুল মন্ডল, নন্দলাল মন্ডল, মাখন লাল মন্ডল, বিপ্রদাস মন্ডল, মনোহর রায়, কানাইলাল মন্ডল, লালচাঁদ মন্ডল। ভান্ডারকো ইউনিয়নের ৪ জন সে দিনে মারা যান। তারা হলেন, ভবনাথ হালদার, নারায়ন রায়, মহাদেব জোদ্দার ও জ্ঞানেন্দ্রনাথ মহালদার।