নড়াইল প্রতিনিধি : নড়াইল জেলা কালচারাল অফিসার হামিদুর রহমানের বদলির আদেশে স্বস্তি ফিরেছে নড়াইল জেলা শিল্পকলা একাডেমির শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সাংস্কৃতিক কর্মীদের মাঝে। তার দ্বারা বৈষম্যের শিকার ও ক্ষতিগ্রস্থরা শুধু বদলি নয়, মহা-দুর্নীতিবাজ এ কর্মকর্তার বিচার দাবি করেছেন।
শিল্পকলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকির ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কালচারাল অফিসার হামিদুর নড়াইলে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। নড়াইলে যোগদানের শুরু থেকেই একের পর এক তার বিরূদ্ধে দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ উঠতে থাকে। স্থানীয় প্রশাসনের তদন্তে তার দুর্নীতি অনিয়মের প্রমান মেলে। কিন্তু কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এতে প্রতবাদিরা হাতশ হয়ে পড়ে। তার বদলিতে জেলা সাংস্কৃতিক অঙ্গন প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সকালে নড়াইলের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক সংগঠক ও বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী মাসুদুল হক টুটুল বলেন, জেলা কালচাল অফিসার হামিদুর রহমান একজন ধূর্ত দুর্নীতিবাজ। অর্থ আত্নসাৎ ও অনিয়মে তার জুড়ি নেই। তার আচরনে ক্ষুব্ধ হয়ে অনেকেই তাকে কালচাড়াল অফিসার বলতেন। জেলা শিল্পকলা একাডেমির সংগীত বিভাগের শিক্ষক আশিষ কুমার স্বপনসহ একাধিক শিক্ষক বলেন, কালচারাল অফিসার হামিদুর রহমান বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সরকার নির্ধারিত সম্মানী ভাতা না দিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর করাতেন। গালমন্দ করতেন। ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করতেন । এ কারণে একাডেমিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা নেই বললেই চলে। তিনি নড়াইলের সংস্কৃতি অঙ্গনকে ধ্বংস করে দিয়েছেন।
দেশের পট পরিবর্তনের পর বেশ কিছুটা চিন্তিত ও আতংকিত ছিলেন জেলা কালচারাল অফিসার হামিদুর রহমান। গত রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) তার বদলির বিষয়টি সর্বমহলে জানাজানি হয়। যদিও গত ২৩ সেপ্টেম্বর শিল্পকলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক ডক্টর সৈয়দ জামিল আহমেদের সাক্ষরিত চিঠিতে তাকে বদলি করা হয়। বদলির বিষয়টি তিনি ব্যক্তিগত ভাবে গোপন রাখলেও গোপন থাকেনি। বদলির বিষয়টি জানাজানি হলে নড়াইল কালচারাল অঙ্গনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। অনেকে মনে করছেন অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি নিজে তদবীর করেই বদলি হয়েছেন।
তার সিমাহীন দুর্নীতি অনিয়ম নিয়ে বিভিন্ন মিডয়াতে সংবাদ প্রকাশিত হয়। স্থানীয প্রশাসন তার বিরূদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তে দুর্নীতির প্রমাণ মেলে। তবে কত টাকার অনিয়ম পাওয়া গেছে, সেটি গণমাধ্যমকে জানায়নি তদন্ত কমিটি। শিল্পকলার শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ ভুক্তভোগীদের হিসাব মতে, হামিদুর রহমান প্রায় ৫০ লাখ টাকার দুর্নীতি করেছেন। ভুক্তভোগিদের দাবি তার বিরূদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা দায়ের করে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করাবে।
তবে স্থানীয়দের ক্ষোভ হামিদুর রহমানকে অপসারণে নড়াইলবাসীর দীর্ঘদিনের দাবির পরও তার বিরূদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। নড়াইলের একজন জনপ্রতিনিধি ও তার পরিবারের আশীর্বাদ এবং শিল্পকলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকির সাথে তার আন্ডার লাইন থাকায় তিনি কাউকে তোয়াক্কা করতেন না।
ভুক্তভোগী শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিক্ষার্থীরা জানান, জেলা কালচারাল অফিসার হামিদুর রহমান ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে নড়াইলে যোগদান করেন। যোগদানের পর দুর্নীতি অনিয়ম ও অর্থ আত্নসাতে মেতে উঠেন। হামিদুর রহমানের বিরূদ্ধে সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিল্পী, কলাকুশলী, বিচারক ও উৎসব সমন্বয়কারীর সম্মানী না দিয়ে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া যাতায়াত ভাড়া না দেয়া, সাজসজ্জা, প্রচারণা, প্রশিক্ষণ, কর্মশালাসহ জেলা শিল্পকলা মিলনায়তনের সাউন্ড, ইলেকট্রিক ও ভবন সংস্কারসহ বিভিন্ন খাত থেকে প্রায় ৫০ লাখ টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠে।
গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কর্মীরা হামিদুর রহমানের বিরূদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির বিরূদ্ধে লিখিত অভিযোগ এনে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশফাকুল হক চৌধুরীর কাছে স্মারকলিপি দেন। এ প্রেক্ষিতে ওই বছরের ২৪ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসন ৫২ জন সাংস্কৃতিক কর্মী, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ করে হামিদুর রহমানের বিরূদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পায়। চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসক কালচারাল অফিসার হামিদুর রহমানের বিরূদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে সংস্কৃতি বিষয়ক সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠান। এরই সূত্র ধরে গত ২ এপ্রিল শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে তদন্ত দল নড়াইলে আসেন। হামিদুর রহমানের বিরূদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির আহবায়ক শিল্পকলা একাডেমির সচিব সালাহউদ্দিন আহাম্মদসহ তিনজন কর্মকর্তা শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সাক্ষ্য নেন। সবাই হামিদুর রহমানের দুর্নীতি অনিয়মের বিষয়ে সাক্ষ্য প্রমাণ দিলেও দীর্ঘদিন ধরে স্বপদে বহাল ছিলেন তিনি। মূলত শিল্পকলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকির প্রভাবে হামিদুর রহমানের ভাবটা ছিলে কুছ পরোয়া নেহি। তাছাড়া নড়াইলের তথাকথিত কিছু শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিকে নগদ নারায়নে ম্যানেজ করেছিলেন এ কর্মকর্তা। নেশাগ্রস্থ ওই তথাকথিত শিল্পীরা তাকে বিভিন্ন সময় ভালো মানুষ বলে প্রচারের অপচেষ্টা চালায়। তাদের কারনে হামিদুর দুর্নীতি করতে আরোও উৎসাহ পান। এর আগে ময়মনসিংহে চাকুরীকালে ব্যাপক দুর্নীতির কারণে হামিদুরকে প্রত্যাহার করা হয়। ময়মনসিংহের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়েও গণমাধ্যমে খবর প্রচার হয়। নড়াইলে যোগদান করার পরেও অনিয়ম ও দুর্নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন হামিদুর। দুর্নীতির প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি। তবে তৎকালীন মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকি কোনো ব্যবস্থা নেননি। যে কারণে বীরদর্পে দুর্নীতি করে গেছেন হামিদুর রহমান।