ডুমুরিয়া : টানা ২ মাসের অতি বর্ষণে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বেশিরভাগ খাল-বিল, চিংড়ি-ঘের, সবজি ক্ষেত, পানিতে তলিয়ে থাকায় অধিকাংশ মানুষের আয়-উপার্যনের পথ বন্ধ হয়ে পড়েছে। বহু বছরের মধ্যে এতোবড় দূর্যোগে পড়া দিনমজুর-দরিদ্র কৃষক তথা সাধারণ মানুষ অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটালেও তেমন-কোনো খাদ্য-সহায়তা পাচ্ছে না।
‘চিংড়ি ঘেরে মাছ-সবজি-ধান চাষ কেন্দ্রীক’ জীবন-জীবিকা নির্ভর সমগ্র ডুমুরিয়া উপজেলার অধিকাংশ মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত-সাধারণ মানুষের জীবনে এবারের অতি-বর্ষণ চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। উপজেলা মৎস্য অফিস সুত্রে জানা গেছে, গত ২ মাসের অতি-বর্ষণে ২০ হাজারের অধিক চিংড়ি ঘের ভেসে যাওয়ায় মাছ ও অবকাঠামোর আনুমানিক ক্ষতি দেড়’শ কোটি টাকা। আর উপজেলা কৃষি অফিস সুত্রে জানা গেছে, দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমান সবজির জোগাদাতা এই ডুমুরিয়ায় ঘেরের আইলের পাশাপাশি ক্ষেতের নানা প্রকার সবজির আনুমানিক ক্ষতি ২’শ কোটি টাকা। তাছাড়া এই জলাবদ্ধতার কারণে আসন্ন বোরো ধানের চাষাবাদ সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় কৃষকরা মহা-অনিশ্চয়তায় পড়েছেন।
ডুমুরিয়া ত্রাণ অফিস সুত্রে জানা গেছে, উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে ২’শ ৪১টি গ্রামের মধ্যে অধিকাংশ গ্রামের বিল-চিংড়ি ঘের তলিয়ে বাড়ি-ঘর রাস্তা-ঘাটেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। তার মধ্যে ধামালিয়া ইউনিয়নের বরুণা, কাঠেঙ্গা, চেচুড়ী-সহ ৮টি গ্রাম, রঘুনাথপুর ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর, মুজারঘুটো-সহ ১০টি গ্রাম, রুদাঘরা ইউনিয়নের খরসঙ্গ, মিকশিমিল, হাসানপুর-সহ ৫টি গ্রাম, খর্ণিয়া ইউনিয়নের সিংগা, পাঁচপোতা-সহ ৫টি গ্রাম, আটলিয়া ইউনিয়নের আধারমানিক-সহ ৮টি গ্রাম, মাগুরাঘোনা ইউনিয়নের ঘোষড়া, কাঞ্চনপুর-সহ ৮টি গ্রাম, শোভনা ইউনিয়নের বারইকাঠি, বাগাছড়া-সহ ৪টি গ্রাম, শরাফপুর ইউনিয়নের আকড়া-সহ ৫টি গ্রাম, সাহস ইউনিয়নের লতাবুনিয়া-সহ ৪টি গ্রাম, ভান্ডারপাড়া ইউনিয়নের তেলিখালি, পেড়িখালি, ধানিবুনিয়া-সহ ৫টি গ্রাম, ডুমুরিয়া সদর ইউনিয়নের মির্জাপুর, বিলপাটিয়ালা, সাজিয়াড়া-সহ ৫টি গ্রাম, রংপুর ইউনিয়নের রংপুর, সাড়াভিটা, বটবেড়া, বারানসি, ঘোনা, শান্তিনগর, শলুয়া, রামকৃষ্ণপুর-সহ ৪টি গ্রাম, গুটুদিয়া ইউনিয়নের লাইন বিলপাবলা, বিলপাবলা, লতা-সহ ৫টি গ্রাম ও মাগুরখালি ইউনিয়নের কাঞ্চননগর-সহ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
তবে এ-সব প্লাবিত এলাকার মধ্যে রংপুর ইউনিয়নের সাড়াভিটা, বটবেড়া, মাগুরাঘোনা ইউনিয়নের ঘোষড়া, কাঞ্চনপুর, ডুমুরিয়া সদর ইউনিয়নের মির্জাপুর, বিলপাটিয়ালা, খর্ণিয়া ইউনিয়নের সিংগা, রঘুনাথপুর ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর, ও আটলিয়া ইউনিয়নের আধারমানিক গ্রামের অবস্থা খুবই মারত্মক। এ-সব গ্রামের বেশিরভাগ কাচা ঘর-বাড়ি ইতোমধ্যে পড়ে গেছে, অধিকাংশ মানুষ খেয়ে-না খেয়ে কোনো রকম দিনাতিপাত করছেন। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে হাতেগোনা কিছু মানুষ নামুুমাত্র কিছু চাল পেলেও প্রয়োজনের তুলনায় সে-টা কিছুই না।
এ প্রসঙ্গে রংপুর ইউনিয়নের ঘোনা গ্রামের মলি মল্লিক বলেন, আমাদের গ্রামে সব ঘের-ভেড়ি তলানে। কারো কোনো কাজ-কাম নেই। ১’শতাধিক পরিবারের বসত ঘরে পানি উঠে গেছে। কিন্তু এখনও কোনো রকম সাহায্য পাইনি। রুদাঘরা ইউনিয়নের শোলগাতিয়া গ্রামের ক্ষুদ্র সবজি বিক্রেতা জিয়াউর রহমান বলেন, আগে এলাকার ঘের-ভেড়ি থেকে সবজি কিনে-বেচে সংসার চালাতাম। এই বর্ষায় তলায়ে সব সবজি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমার কোনো কাজ নেই। খুব কষ্টে জীবন-ধারণ করলিউ কোনো সহায়তা পাইনি। ডুমুরিয়া ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের রুইদাস মন্ডল বলেন, কিছুদিন আগে বিএনপি’র এক নেতা কিছু চাল-আলু দিলো, তাছাড়া কোনো সাহায্য দেখিনি।
এলাকার সচেতন নাগরিক মোশাররফ হোসেন কচি বলেন, দীর্ঘ সময়ের এই জলাবদ্ধতায় চাষি-দিনমজুরের কোনো কাজও নেই, মানে খাবারও নেই। তাছাড়া অনেক কৃষক আবার এনজিও’র কাছে কিস্তির জালে বাধা। উপজেলার মধ্যে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ রংপুর ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ সমরেশ মন্ডল বলেন, আমার ইউনিয়নের প্রায় সকল ঘেরভেড়ি, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে আছে। অধিকাংশ মানুষের কোনো কাজকাম না থাকায় চরম সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে সাড়াভিটা, বটবেড়া, বারানসি ও মুজারঘুটা গ্রামে হাজারের অধিক পরিবারের জন্য জরুরি খাদ্য সাহায্য প্রয়োজন। উপজেলা ত্রাণ কর্মকর্তা আশরাফ হোসেন বলেন, গত ২ মাসে আমরা উপজেলার সকল ইউপি চেয়ারম্যানের মাধ্যমে দুস্থ-অসহায় মানুষের জন্য তিন-ধাপে মোট ৪৩ মেট্রিক টন চাল ও ২ লাখ টাকা বিতরণ করেছি। তবে রংপুর, রঘুনাথপুর, ডুমুরিয়া, খর্ণিয়া, মাগুরাঘোনা ও আটলিয়া ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে মানুষের খুব দূরাবস্থা চলছে।
ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাসনিম জাহান বলেন, সমগ্র ডুমুরিয়া উপজেলার প্রায় সকল চিংড়ি ঘের, সবজি ক্ষেত, বাড়িঘর, গ্রামীন রাস্তাঘাট পানিতে তলানো। হাজার-হাজার দূর্গত প্রান্তিক মানুষের জন্য আরও খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন উল্লেখ করে জেলায় চাহিদাপত্র পাঠিয়েছি।