অভিনব পন্থায় আবাসিক হোটেলগুলোতে চলছে দেহ ব্যবসা 

প্রকাশঃ ২০১৯-০৭-২১ - ১২:২৭

দেহ ব্যবসার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা কেএমপি কমিশনারের

বিউটি পার্লার ও ভাড়া বাড়িতে গড়ে উঠেছে মিনি পতিতালয়

 খুলনার তিন থানা এলাকায় যৌনকর্মীর সংখ্যা ১১শ

নিউমার্কেটে অর্ধশতাধিক কলগার্লের বিচরণ

কামরুল হোসেন মনি : অভিনব পন্থায় খুলনার ১শটির বেশি আবাসিক হোটেলে দেহ ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে। কৌশলে যৌনকর্মীদেরকে হোটেলের আয়া ও বাবুর্চি সাজিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে এ ব্যবসা। খুলনা সোনাডাঙ্গা মডেল থানা, সদর থানা ও খালিশপুর থানাধীন (আংশিক) এলাকাজুড়ে ১১২২ জন যৌনকর্মী রয়েছে। এর বাইরে নিরালা, সোনাডাঙ্গা, ময়লাপোতা, ডালমিল মোড়, রূপসা মোড়, খালিশপুর এলাকায় বিউটি পার্লার ও একাধিক আবাসিক ভাড়া বাড়িতে গড়ে উঠেছে মিনি পতিতালয়। সেক্ষেত্রে পেশাদার ও অপেশাদার মিলিয়ে যৌনকর্মীর সংখ্যা ১২ হাজারেরও বেশি। প্রতি বছর হাজারের ওপরে যৌনকর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দারিদ্রতা ও কর্মসংস্থানের অভাবে সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে নারীরা অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছেন।
সম্প্রতি খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি) কয়েকটি আবাসিক হোটেলে অভিযান চালিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগে পুরুষ ও মহিলাসহ ৯ জনকে আটক করেন। অভিযানটি ঝিমিয়ে পড়ায় কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় পুনরায় এই ব্যবসাগুলো অভিনব পন্থায় পরিচালনা করা হচ্ছে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার খন্দকার লুৎফুল কবির এ প্রতিবেদককে বলেন, আবাসিক হোটেল আর ভাড়া বাড়িতে যারাই এই অসামাজিক কার্যকলাপের সাথে জড়িত থাকবে তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এ ধরনের কোনো তথ্য থাকলে আমাকে জানিয়ে সহযোগিতা করেন। সমাজ সুরক্ষায় হোটেলগুলোতে প্রয়োজনে বিশেষ অভিযান চালানো হবে। দেহ ব্যবসার বিরুদ্ধে আমার জিহাদ ঘোষণা রইলো।
জানা গেছে, খুলনা মহানগরীতে শতাধিক আবাসিক হোটেলে যৌনচার চলছে। এ সব হোটেলগুলোতে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্রীদেরকে নিয়ে দেহ ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে। অনেক নারীকে ফাঁদে ফেলে এই পেশায় আসতে বাধ্য করা হচ্ছে। অনিরাপদ এসব যৌনাচার সামাজিকভাবে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
গোয়েন্দার সূত্র মতে, নগরীর নিরালা, সোনাডাঙ্গা, বয়রা, খালিশপুর, নিউমার্কেট এলাকায় একাধিক ভাড়া বাড়িতে গড়ে উঠেছে মিনি পতিতলায়। অবৈধ কর্মকা- সম্পর্কে বিভিন্ন সময় এলাকাবাসী প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করে থাকে। এক শ্রেণির অসাধু পুলিশের সহযোগিতার কারণে অভিযোগের বাস্তবতায় কোনো ফল হয় না। নগরীর বেশ কিছু বাসাবাড়িতে বিভিন্ন স্থান থেকে যৌনকর্মীদের সংগ্রহ করে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে কয়েকজন সচুতুর মহিলা দেহ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে নগরীর ডালমিল মোড় এলাকায়, নিরালায় দুটি বাড়ি, খালিশপুর হাউজিং এ একটি বাড়িতে, রূপসা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একটি বাড়িতে এক মহিলার নেতৃত্বে দেহ ব্যবসা চলছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠা বিউটি পার্লারের আড়ালে দেহ ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন লাইট হাউজ এর হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালে ২৪ জুন পর্যন্ত নগরীর তিন থানাধীন এলাকায় যৌনকর্মীর সংখ্যা রয়েছে ১১শ ২২ জন। যার মধ্যে হোটেলে যৌনকর্মীর সংখ্যা রয়েছে ৭৫ জন, আবাসিকে রয়েছে ৪৮৬ জন ও ভাসমান যৌনকর্মী রয়েছে ৫৬১ জন। এসব যৌনকর্মীকে লাইট হাউজের মাধ্যমে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। এর আগে ২০১৮ সালের যৌন কর্মী ছিল ১ হাজার ৪২ জন এবং ২০১৭ সালে ছিল ৮৫০ জন যৌনকর্মী। এর আগে ২০১৬ সালে ছিল ৭১৯ জন।
সূত্র মতে, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন লাইট হাউজ খুলনা সদর থানা, সোনাডাঙ্গা থানা, খালিশপুর আংশিক এলাকায় ও পূর্ব রূপসার আংশিক এলাকায় তাদের এই সংগঠন যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্যসেবা, প্রশিক্ষণসহ নানা ধরনের সেবা প্রদান করে থাকেন। সূত্র মতে, বাইরে খুলনায় যৌনকর্মীর সংখ্যা রয়েছে ১২ হাজারের বেশি।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দূর্জয় নারী সংঘের সর্বশেষ ২০০৪ সালের হিসেব অনুযায়ী নগরীতে পেশাদার যৌনকর্মী ছিলো ৩ হাজার ৫০০ জন। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ওয়ার্ল্ড ভিশনের সর্বশেষ ২০০৫ সালের তথ্য অনুযায়ী নগরীতে অপেশাদার যৌনকর্মী রয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৫০০ জন। এছাড়া রয়েছে ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মী। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাজ করে তারা চলে যায়। শহর সংলগ্ন বিভিন্ন উপজেলা এবং বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের অভাবী মেয়েরা যৌনকাজে লিপ্ত হচ্ছে। তারা দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় শহরে আসছে এবং কাজ শেষে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।
গোয়েন্দা পুলিশের গোপন প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, নগরীর বড়বাজার হেলাতলা এলাকায় হোটেল সোসাইটি। এ হোটেলের মালিক এস এম আলম। হোটেলের ম্যানেজার সিদ্দিকুর রহমান দেহ ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এছাড়া নগরীর পিকচ্যার প্যালেস মোড়ে হোটেল আর্কেডিয়া, হোটেল আজম হোসেন ইন্টারন্যাশনাল, থানার সামনে হোটেল স্টার, ফেরিঘাট মৌসুমী আবাসিক হোটেল, লোয়ার যশোর রোডের সোনার বাংলা আবাসিক হোটেল, হোটেল বসুন্ধরা, হোটেল আমিনা, হোটেল সোহাগ মিলন, হোটেল শাহীন, হোটেল কদর, হোটেল সুফি, খুলনা হোটেল, হোটেল আরাম, বৈশাখী হোটেল, সুন্দরবন হোটেল, হোটেল পার্ক, হোটেল আরাফাত, বরিশাল হোটেল, হোটেল মুন, হোটেল প্যারাডাইস, সাতক্ষীরা হোটেল, হোটেল সানলাইট, হোটেল সানডে, হোটেল গোল্ডেন কিং, হোটেল মালেক গার্ডেন, হোটেল জেলিকো, হোটেল এনিটাসহ নগরীর শতাধিক হোটেলেই দেহ ব্যবসা হচ্ছে। এ সব আবাসিক হোটেলগুলোতে রাতের চেয়ে দিনের বেলায় দেহ ব্যবসা হয় বেশি বলে সূত্রটি জানায়। পুলিশ প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে তারা ভিন্ন কৌশলে অবলম্বন করছেন। যৌনকর্মীদের হোটেলের আয়া বা বাবুর্চির কার্ড ঝুলিয়ে রাখলেও মূলত তাদেরকে দিয়ে দেহ ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে। নিউমার্কেটে প্রায় অর্ধশতাধিক কলগার্ল বিচরণ করে। এক শ্রেণির দালাল তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে দেয়। নগরীর বয়রা এলাকায় দুইজন মেয়ে নিউমার্কেট থেকে ক্রেতাদের সাথে কলগার্লদের কন্ট্রাক্ট করে দেয়। নিউমার্কেটের মধ্যে অনেক সময় তারা একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসে আড্ডায় মেতে থাকেন। নগরীর বৈকালি ঝুড়ির ভিটা, মুজগুন্নী স্টেডিয়ামের পাশে, ফুলবাড়ীগেট ও বয়রা এলাকায় কয়েকটি হোস্টেলের নিবাসীদের বিরুদ্ধে যৌন কাজে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
চলতি বছরে গত মার্চ মাসে খুলনা মহানগরীতে দুইটি হোটেল থেকে অনৈতিক কার্যকলাপের সাথে জড়িত থাকায় ৪ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলাকে আটক করে পুলিশ। কেএমপি গোয়েন্দা পুলিশ এই অভিযান পরিচালনা করেন। তৎকালীন কেএমপি ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কমিশনার সরদার রকিবুল ইসলামের নির্দেশে এবং প্রত্যক্ষ তদারকিতে গোয়েন্দা টিম এ অভিযান পরিচালনা করে ফেরিঘাটের মৌসুমী আবাসিক হোটেল এবং লোয়ার যশোর রোডের সোনার বাংলা আবাসিক হোটেল থেকে উল্লিখিতদের আটক করা হয়। এছাড়া ২৭ ফেব্রুয়ারি সদর থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে চারজন পুরুষ ও পাঁচজন মহিলাকে আটক করা হয়। গোয়েন্দা পুলিশ তাদেরকে অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগে সদর থানাধীন ফেরিঘাটের মৌসুমী আবাসিক হোটেল এবং লোয়ার যশোর রোডের সোনার বাংলা আবাসিক হোটেল থেকে আটক করে। এর আগের দিন ২৬ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন আবাসিক হোটেল থেকে ৪ নারী পুরুষকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ।