খুলনায় বিদেশি মদ-বিয়ার টাকা প্রাইভেটকারসহ আটক ২

প্রকাশঃ ২০১৯-১০-১৪ - ১২:২২

মাদকের গডফাদারের তালিকার শাহজাহান পলাতক, স্বীকারোক্তি শাহজাহানের মদ-বিয়ার এনে বিক্রি

কামরুল হোসেন মনি : খুলনা মহানগরীতে পৃথক অভিযান চালিয়ে বিদেশি মদ, বিয়ার ও মাদক বিক্রির ৪০ হাজার ২শ টাকা ও ব্যবহৃত প্রাইভেটকারসহ দুজনকে থানা পুলিশ আটক করেছেন। আটককৃতরা হচ্ছে জিকো রায় (২৮) এবং গাড়ি চালক আওয়াল উদ্দীন (৩৮)।
১৩ অক্টোবর শনিবার দিবাগত রাতে খুলনা সদর ও লবণচরা থানা পুলিশ পৃথক অভিযান চালিয়ে নগরীর নিরালা আবাসিক এলাকা ও সাচিবুনিয়া এলাকা থেকে তাদেরকে আটক করেন। এর মধ্যে আসামি জিকো রায় রোববার ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন। তিনি শাহজাহানের কাছ থেকে মদ ও বিয়ার এনে বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করতেন। মহানগর হাকিম তরিকুল ইসলামের কাছে এ জবানবন্দি প্রদান করেন। এ ঘটনায় পৃথক থানায় মাদক বিক্রেতা শাহজাহানকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। বর্তমানে তিনি পলাতক রয়েছেন।
খুলনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসলাম বাহার বুলবুল জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শনিবার দিবাগত রাত ১টায় খুলনা থানাধীন নিরালা আবাসিক ১নং রোডস্থ হোল্ডিং নং-৯৭, নাজমা নীড়ে অভিযান চালিয়ে চার বোতল এম্পিরিয়াল, এক বোতল হুইস্কি, দুই বোতল তাসরিনা ভোদকা, এক বোতল অরেঞ্জ কিউরাকো, ২১ ক্যান বেলজিয়াম বিয়ার, ১২ ক্যান রয়েল ডাচ বিয়ার এবং বিক্রিত ৪০ হাজার ২শ টাকা উদ্ধার করা হয়। ওই সময় আসামি জিকো রায়কে আটক করা হয়। রোববার তাকে আদালতে হাজির করা হয়। মহানগর হাকিম তরিকুল ইসলাম এর আদালতে আসামি জিকো রায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন। স্বীকারোক্তিতে বলেন, পলাতক আসামি শাহাজাহান হাওলাদারের কাছ থেকে এগুলো নিয়ে এসে বিক্রি করতেন। জিকো বটিয়াঘাটা থানাধীন দেবীতলা এলাকার অঞ্জণ রায়ের পুত্র।
অপরদিকে কেএমপির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মনিরুজ্জামান মিঠু জানান, শনিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে লবণচরা থানা পুলিশের একটি দল সাচিবুনিয়া বিশ্বরোড মোড়স্থ আলোক ভবনের সামনে পাকা রাস্তার ওপর একটি প্রাইভেটকারে (ঢাকা মেট্রো গ-২৯৮৯১৩) তল্লাশি চালিয়ে ৫ ক্যান বেলজিয়ান বিয়ার, ১ বোতল হুইস্কি ও ১ বোতল মদ উদ্ধার করে। উক্ত গাড়ির চালক আইউব উদ্দীন মুন্সীর পুত্র আউয়াল উদ্দীনকে লবণচরা থানা পুলিশ আটক করে। তিনি লবণচরা থানাধীন সাচিবুনিয়া এলাকায় বসবাস করেন। একই এলাকায় এ ঘটনায় উক্ত ধৃত আসামিসহ পলাতক আসামি মৃত মজিদ হাওলাদারের পুত্র শাহজাহান হাওলাদারকে (৫৪) আসামি করে লবণচরা থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করা হয়েছে।
লবণচরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তদন্ত বায়োজিদ আকন এ প্রতিবেদককে জানান, আটক আউয়াল উদ্দীনকে মদ ও বিয়ারসহ আটক করা হয়। এ সময় ওই সব মাদক বিক্রিতে ব্যবহৃত প্রাইভেটকার জব্দ করা হয়েছে। তিনি শাহজাহানের কাছ থেকে ওই সব মাদক এনে বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করে আসছিলেন। শাহজাহানের মাদক ব্যবসায় ব্যবহৃত প্রাইভেটকার আটক করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
খুলনা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ রাশেদুজ্জামান বলেন, খুলনার মাদকের গডফাদারের তালিকায় অন্যতম একজন শাহজাহান। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মাদকের মামলা ছিলো। মাদকের গডফাদার শাহজাহানের বাসায় এর আগে অভিযান পরিচালনা করা হয়। তিনি খুলনা জেলায় বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে বিদেশি মদ, হুইস্কি ও বিয়ার সরবরাহ করতেন। একাধিকবার তিনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছেন।
জানা গেছে, লবণচরা থানাধীন সাচিবুনিয়া বাজারে মাদক স¤্রাট শাহজাহানের ‘সোনালী কটেজ’ নামে ৪ তলা বিল্ডিং রয়েছে। ওই বাড়িটি শাহজাহানের মেয়ে ‘সোনালী’র নামে ‘সোনালী কটেজ’ বিল্ডিংয়ে নাম দেওয়া হয়। ওই বিল্ডিংয়ের নিচে কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মার্কেট রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন এলাকাবাসী জানান, সাচিবুনিয়া স্কুল রোডে ঢুকে আমেরিকান ডলার নামক বাড়ির স্থানে ১০ কাঠা জায়গা নিয়ে মাদক স¤্রাট শাহজাহানের রয়েছে একটি বাগানবাড়ি। সেখানে প্রায় পুলিশ প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রীতিভোজ আয়োজন করেন। এ কারণে এলাকাবাসী শাহজাহানের অপকর্মের জন্য ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চায় না। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সাথে একজন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক থাকলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া কঠিন। আওয়ামী লীগ সরকারের নাম ভাঙিয়ে একজন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী শাহজাহানের ছবি দিয়ে পোস্টার ছাপাতে দেখা গেছে। যা দলের ইমেজ নষ্ট করছে।
সূত্র মতে, ২০১৭ সালে ২৯ ডিসেম্বর র‌্যাব-৬ সন্ধ্যায় নগরীর সোনাডাঙ্গা থানাধীন পৃথক আস্তানায় অভিযান চালিয়ে ২৬৩টি বিয়ার ক্যান ও ১৫৭ বোতল দেশি-বিদেশি মদসহ মূল চোরাকারবারী শাহজাহানসহ ৭ জনকে আটক করেন। জব্দকৃত মদ ও বিয়ারের মূল্য আনুমানিক ১০ লাখ। শাহজাহানের সেকেন্ড ইন কমান্ড মনা ও মাদক বহনে ব্যবহৃত গাড়ির চালক আলমগীর ওই সময় পলাতক ছিলেন। পরের দিন ৩০ ডিসেম্বর র‌্যাব-৬ এর কার্যালয়ে প্রেস বিফিং এর মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়। এর আগে শাহজাহানের মাদকের একাধিক চালান ধরা পড়লেও তিনি সব সময় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এবার নিয়ে তিনি দুবার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হন। তৎকালীন র‌্যাব-৬ এর স্পেশাল কোম্পানি কমান্ডার মোঃ এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, খুলনার মাদক স¤্রাট শাহজাহান ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনকে ঘিরে অবৈধ বিদেশি মদ ব্যাপকভাবে বিক্রি করেছে এবং ৩১ ডিসেম্বর থার্টি ফার্স্ট নাইটকে কেন্দ্র করে বিপুল পরিমাণ বিদেশি অবৈধ মদ ও বিয়ার বিক্রির উদ্দেশে মজুদ করেছিলেন। এমন গোপন তথ্যের ভিত্তিতে তার নেতৃত্বে ২৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে নগরীর সোনাডাঙ্গা থানাধীন মজিদ সরণি বটতলাস্থ মাদক স¤্রাট শাহজাহান এর সোনালী এন্টারপ্রাইজ গ্রিল ওয়ার্কশপ এর ভেতর থেকে এবং এম এ বারি সড়কের দারুল সালাম মহল্লার ২৮/৬ নম্বর বাসায় র‌্যাব-৬ এর একটি টিম অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় সোনালী এন্টারপ্রাইজ গ্রিল ওয়ার্কশপ ও দারুল সালাম মহল্লার পৃথক আস্তানায় অভিযানে মোট বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি বিয়ার ২৬৩ ক্যান ও দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের ১৫৭ বোতল মদ উদ্ধার করা হয়। অভিযানে মাদক স¤্রাট শাহজাহানসহ ৭ জনকে আটক করেন। আটককৃত অন্যারা হচ্ছেন চুয়াডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা মোঃ আসাদুল বিশ্বাসের পুত্র মোঃ সাগর বিশ্বাস, নগরীর টুটপাড়া এলাকার বাসিন্দা পাকুন জয়ধর এর পুত্র সুশীল জয়ধর, দক্ষিণ বাগমারা এলাকার বাসিন্দা মোঃ নিজাম উদ্দিনের পুত্র মেহেদী হাসান, বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ সোনাখালী এলাকার বাসিন্দা মৃত মজিদ গাজীর পুত্র মোঃ রুস্তুম গাজী, পশ্চিম বানিয়াখামার এলাকার বাসিন্দা শেখ জাহাঙ্গীর কবিরের পুত্র শেখ রাসেল কবির ও দারুস সালাম মহল্লা এলাকার বাসিন্দা বায়তুল ইসলামের স্ত্রী মোসাঃ পপি ইসলাম। অবৈধ মদ ও বিয়ার আটক শাহজাহান ঢাকা ও মোংলা পোর্ট থেকে তার ব্যবহৃত প্রাইভেটকারে করে চালান এনে মজুদ করতেন। শাহজাহানের সেকেন্ড ইন কমান্ড মনা ওরফে মনো নামে পরিচিত ও মাদক বহনের যানবাহন চালক আলমগীর হোসেন পলাতক ছিলেন। এর আগে ২০১৬ সালের ১৮ আগস্ট নগরীর সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ ও বিয়ার উদ্ধার করে র‌্যাব। এ সময় মাদক ব্যবসায়ী শাহাজাহান হাওলাদারের স্ত্রী ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মুন্নি আকতারকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এ সময় ওই বাড়ি থেকে বাংলাদেশের কেরু অ্যান্ড কোম্পানি এবং স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের নানা ব্রান্ডের ৪৫৫ বোতল মদ ও ৭৩৬ ক্যান বিয়ার এবং দু’টি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার করা মাদকদ্রব্যের মূল্য ৩৬ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। তবে এ সময়ও শাহজাহানকে পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় নগরীর সোনাডাঙ্গা থানায় মামলা হয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালের ৫ নভেম্বর সকাল ১১টায় নগরীর খুলনা ক্লাব সংলগ্ন পুলিশ লাইনের সামনের সড়ক থেকে ১৮ বোতল মদসহ তাকে আটক করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি। এছাড়া ২০১১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকা থেকে ১৪৫ বোতল বিদেশি মদ ও ৭২ ক্যান বিয়ারসহ খানজাহান আলী (র.) সেতু এলাকা থেকে পুলিশ একটি প্রাইভেটকারসহ শাহজাহানের দু’জন সহযোগিকে গ্রেফতার করে। একই বছরের ২৭ মার্চ নগরীর ৩ নম্বর মির্জাপুরে শাহজাহানের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মদ ও জাল নোট উদ্ধার করা হয়।। ২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিল পুলিশ নগরীর সিমেট্রি রোডের একটি আবাসিক ভবনে অভিযান চালিয়ে শাহজাহানের ২২ লক্ষাধিক টাকা মূল্যের প্রায় ৫শ বোতল দেশি-বিদেশি মদ ও বিয়ার উদ্ধার করে। নগরীর সিমেট্রি রোডে শাহজাহানের ভাড়া বাড়িতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে ২৬৬ ক্যান বিয়ার, ২২১ বোতল দেশি-বিদেশি মদ এবং মদ বিক্রির ১২ হাজার ৮শ নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়। তবে পুলিশ সেবারও শাহজাহানকে ধরতে পারেনি। এমনকি এ মামলায় শাহজাহানকে আসামি পর্যন্ত করা হয়নি।