বুলবুলের ক্ষতে প্রলেপ পড়েনি কয়রার বহু গ্রামে

প্রকাশঃ ২০২০-০১-০৯ - ০৯:৩৬

ইমতিয়াজ উদ্দিন, কয়রা : খুলনার কয়রা উপজেলা পরিষদ ভবন থেকে খানিক দূরে মদিনাবাদ পুরোনো লঞ্চঘাট। এক সময় এখানে জমজমাট ঘাট ছিল। লঞ্চ আসতো বিভিন্ন এলাকা থেকে। সেই ঘাটটি বহু আগে কপোতাক্ষের স্রোতে হারিয়ে গেলেও এখনও এলাকাটিকে সবাই লঞ্চঘাট হিসাবেই চেনে।লঞ্চ ঘাটের রাস্তাধরে একটু সামনে অগ্রসর হতেই চোখে পড়ে ভাঙা একটি ঘর ছাউনিসমেত পড়ে আছে মাটিতে।স্থানীয়রা জানালো গত ১০ নভেম্বর ঘরটি ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে ভেঙে পড়ে। ঘরের লোকজন কোথায় থাকে? জানতে চাইলে একজন হাতের ইশারায় পাসের টিনের ঘরটি দেখিয়ে দিলেন। জানাগেল ভাঙা ঘরটির মালিক ভ্যান চালক ইলিয়াস গাজী।বুলবুলের তান্ডবে ঘর ভেঙে যাওয়ায় পরিবার নিয়ে থাকছেন পাসের বাড়ির ইউনুস গাজীর ঘরে। ভ্যান চালক ইলিয়াস গাজীর স্ত্রী বিলকিস বেগমের সাথে কথা হলে তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, স্বামী-স্ত্রী অন্যের বাড়িতে বসবাস করছি। প্রশাসন আমাদের দেখতে পায় না। আজ পর্যন্ত কোনও সরকারি সাহায্য পাইনি আমরা।
কয়রা সদর থেকে দক্ষিণ দিকে দুই কিলোমিটার গেলেই গোবরা গ্রাম। কপোতাক্ষের তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা গ্রামটির বেড়ি বাঁধের গা ঘেঁসে আবদুল জলিলের ঘরটি এখনও বুলবুলের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। ঘরের উপর গাছ উপড়ে ভেঙে পড়ে আছে চালের কিছুটা অংশ আর মাটির দেয়াল। ঝড়ের দুই মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও অর্থসংকটে ঘরটি আজও মেরামত করতে পারেননি ঘরটির মালিক আব্দুল জলিল। ভাঙা ঘরটির একটি অংশে শীতের মধ্যে ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে কোনোমতে বাস করছেন তিনি।
সর্বনাশা বুলবুলে উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের হরিহরপুর এলাকার বামাচরণ মন্ডলের সর্বস্ব কেড়ে নেয়ায় পরিবার নিয়ে পার্শবর্তী উপজেলা পাইকগাছায় শশুরবাড়িতে চলেযেতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। তার আরেক ভাই নিত্যনন্দ মন্ডল বাপ-দাদার পুরনো ভিটে ছেড়ে দিয়ে মাথা গুজে আছে বেড়ীবাঁধের ধারে। শত চেষ্টা করেও সব হারানো এই পরিবারের পক্ষে এখনো ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি। নিত্যনন্দ মন্ডল জানালেন, বাড়ি-ঘর সব নষ্ট। মাটির উপরে কোনও মতে ছেঁড়া ত্রিপল ঢাকা দিয়ে প্রায় অনাহারে দিন কাটছে তাদের।
উপজেলাটির সর্বদক্ষিণের ইউনিয়নটির নাম দক্ষিণ বেদকাশী। এই ইউনিয়নের সর্বদক্ষিণে শাকবাড়িয়া নদী তীরবর্তী এলাকার নাম গোলখালী। গোলখালী এলাকার মাজেদা বেগম ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের ক্ষত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রলয়ঙ্কারী এ ঝড়ে তার ঝুপড়ি ঘরটি উড়ে গেছে। লন্ড-ভন্ড- হয়ে গেছে মাথা গোঁজার ঠাই। নিরুপায় হয়ে মাজেদা বেগমকে ঠাই নিতে হয়েছে প্রতিবেশির পোল্ট্রি মুরগির খামার ঘরের এক কোনে। মুরগির বিষ্ঠার দূর্গন্ধে যেখানে স্বাভাবিক মানুষের দাড়িয়ে থাকা দায়, সেখানে রাত যাপনও করতে হয় তার। টাকার অভাবে নিজের ঘরটি মেরামত করতে পারেনি এখনও। কোনরকম সহযোগিতাও জোটেনি কপালে। বুলবুলের ক্ষত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি ওই বৃদ্ধা।
বুলবুলের পর সুন্দরবনঘেঁষা এই উপজেলার শত শত মানুষের দিন কাটছে এভাবেই। প্রচন্ড শীতের মধ্যে জবুথবু হয়ে কোনো রকমে দিন পার করছেন তাঁরা। আর্থিক সংগতি না থাকায় একটু সাহায্যের আশায় তাকিয়ে আছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দিকে। ঝড়ের পর কিছু কিছু পরিবার আর্থিক সাহায্য পেলেও অধিকাংশই থেকে গেছে এর বাইরে।
গত ১০ নভেম্বর উপকূলীয় এই জনপদের উপর আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। ঘূর্ণিঝড়ের পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি ক্ষতিগ্রস্ত এই উপজেলার মানুষ। স্থানীয়রা বলছেন নদীবাঁধ না ভাঙায়, আইলার মতো অতটা ভয়াবহ হয়ে ওঠেনি বুলবুল। ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো গিয়েছে অনেকটাই। তবে দু’একটি জায়গায় সামান্য ধস নেমেছে। এলাকাবাসীদের দাবি, জোয়ারের সময় যদি এই ঝড় হত, তাহলে নদীবাঁধগুলিকে বাঁচানো যেতো না। ভয়াবহতা হয়তো হার মানাতো আয়লাকেও।
সরেজমিনে উপকূলীয় উপজেলাটির বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে বুলবুলের ক্ষত এখনও টাটকা কয়রার বহু গ্রামে। ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছ সরিয়ে, ঘরের চাল মেরামত করে দৈনন্দিন ছন্দে ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এই এলাকার মানুষেরা। খুলনা শহর থেকে সড়ক পথে একশত কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পৌঁছাতে হয় উপজেলা সদরে। সড়কের পাশের অনেক বড় বড় গাছ উপড়ে পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সড়কের কিনার।
ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় মধ্যে রয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো।
কয়রা উপজেলা প্রশাসন সুত্রে জানাযায়, বুলবুলের তান্ডবে উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের ২ হাজার ৩শত ঘরবাড়ি একেবারেই বিদ্ধস্ত হয়েযায়। আর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৪ হাজার ৮শত ঘর।
কয়রা উপজেলার কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী কয়রার মোট ৪০ হাজার কৃষক পরিবারের অধিকাংশই বুলবুলের ছোবলে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিজান মাহমুদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে আমরা এ পর্যন্ত চারশো ৭১ হেক্টর জমির আমন ধান একেবারেই নষ্ট হওয়ার খবর পেয়েছি। মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে কয়রার ৩ হাজার ২৬০ টি মৎস্য ঘের পানিতে নিমজ্জিত হয়েছিল। যার আয়তন ৩৩শ হেক্টর।
বুলবুলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনয়ন। ওই এলাকার কেউ গৃহহারা, কেউ ফসলহারা, কেউ মাছ শিকারের নৌকাহারা হয়েছে। দক্ষিণ বেদকাশী ইউপি চেয়ারম্যান কবি শামসুর রাহমান জানান, তার ইউনিয়নে কয়েক হাজার বিঘা জমির মৎসঘের ঘের ভেসে গেছে। ঘরবাড়ি বিদ্ধস্ত হয়েছে প্রায় দুই হাজারের অধিক। তবে সরকারি সহযোগিতা হিসেবে পেয়েছেন মাত্র ৫৮ বান্ডিল টিন আর বান্ডিল প্রতি তিন হাজার করে টাকা। যা প্রয়জোনের তুলনায় একেবারেই সামান্য। বিধ্বস্ত পরিবারগুলোর অনেকেই খোলা আকাশের নিচে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর দিনযাপন করছে।আবার অনেকেই আর্থিক সমস্যায় পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি ঘর সংস্কার করতে না পারায় তাদেরকে ছেলেমেয়ে নিয়ে অভাব-অনটনে দিনযাপন করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, উপজেলা পরিষদে ক্ষতিগ্রস্তের তালিকা প্রদান করা হলেও এখনও পর্যন্ত সকলের জন্য ত্রাণসামগ্রী পাওয়া যায়নি।
উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান গনেশ চন্দ্র মন্ডল জানান, তার ইউনিয়নটির তিন শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ও এগারশর অধিক বসতবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো পলিথিনের ছাউনি ও জোড়াতালি দিয়ে ঘর মেরামত করতে সক্ষম হলেও বিধ্বস্ত পরিবারগুলোর অনেকেই খোলা আকাশের নিচে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর দিনযাপন করছে। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য । তিনি জানান উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নে মাত্র ৩৮ বান্ডেল টিন ও বান্ডেল প্রতি তিন হাজার করে টাকা দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জাফর রানা জানান, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা করে ইউনিয়নভিত্তিক ত্রাণ বিতরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তুলনায় বরাদ্দ কম থাকায় হিমশিম খেতে হচ্ছে উপজেলা প্রশাসনকে।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিমুল কুমার সাহা বলেন, দূর্যোগ পরবর্তী পরিস্থিতিতে মানবিক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে সরকারিভাবে ২ লক্ষ ৫০হাজার টাকা, ৫০মেট্রিক টন চাল ও ৭০০ প্যাকেজ শুকনা খাবার বরাদ্দ পাওয়া গিয়েছিল। সেগুলো ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে তাতক্ষনিক ভাবে বিতরণ করা হয়েছিল। এছাড়া পরবর্তীতে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ২৫০ বান্ডেল টিন ও ৭ লক্ষ টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। সেগুলিও ইউনিয়ন অয়িজ বন্টন করে দেয়াহয়েছে। ত্রাণ ও পুনর্বাসনের সহযোগিতা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বিষয়টি শিকার করে উপজেলার এই নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। কিছু ঘর অথবা গৃহ নির্মানের জন্য আর্থিক সহায়তার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে আবেদনও করা হয়েছ। সাহায্য পেলে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কাজ শুরু করা হবে।