গোপালগঞ্জ : ‘রেশমা’ তার সদ্যজাত কন্যা-সন্তানকে নিয়ে এখন গোপালগঞ্জ আড়াই’শ বেড জেনারেল হাসপাতালের গাইনী বিভাগের পোষ্ট অপারেটিভ-৩নং বেডে চিকিৎসাধীন রয়েছে। গৃহকর্ত্রীর বাড়িতে দিনের পর দিন আটক অবস্থায় ধর্ষণের শিকারে অন্ত:সত্বা হয়ে গত ১০ জানুয়ারি সে হাসপাতালে ভর্তি হয়। রবিবার দুপুরে হাসপাতালের গাইনী বিভাগের অধীনে তার সিজার হয় এবং সে ওই কন্যা-সন্তানের জন্ম দেয়। হাসপাতালের বিছানায় অসুস্থ রেশমা আর্তনাদের সুরে শুধু এটুকুনই বলেছে ‘আমি এখন কী করব? আমার এ সন্তানেরই বা কী হবে? বিচার চাই আমি।
হাসপাতালে আসার আগেই রেশমা (১৯) কথা বলে মিডিয়ার সামনে এবং জানায়, সে ফরিদপুর জেলার সালতা উপজেলার কামাইদা গ্রামের দরিদ্র শফি মাতুব্বরের মেয়ে। তিন বছর আগে তাকে গৃহপরিচারিকার কাজে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থানার এস আই কামরুল ইসলাম। তার একমাত্র সন্তান আলীফ হোসেনকে দেখাশুনা আর ঘরের কাজ কর্ম করে ভালোই কাটছিল রেশমা’র দিনগুলি। এভাবে বছর দেড়েক যেতেই ঢাকার কাঁচপুর ব্রীজের কাছে সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হন গৃহকর্তা এসআই কামরুল ইসলাম।
মাস খানেক পর কামরুল ইসলামের স্ত্রী সেতু বেগম তার সন্তান আলীফ ও গৃহপরিচারিকা রেশমাকে নিয়ে এসে আশ্রয় নেয় গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার পুখরিয়া গ্রামে তার নানা ইয়ার আলী মোল্লার বাড়িতে বাবা-মা’র সংসারে। সেখানে বসবাসের এক পর্যায়ে উচ্চভিলাষী সেতু নিজেই শুরু করে বেপরোয়া জীবন-যাপন। ভর্তি হয় মহিলা কলেজে আর সেই সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে কতিপয় যুবকের সঙ্গে, যারা রাত-বিরাতে যাওয়া-আসা করত ওই বাড়িতে। সেতু জড়িয়ে পড়ে দেহ-ব্যবসায়। সখ্যতা গড়ে নেয় পুলিশের সঙ্গেও। এরই মাঝে চর পুখরিয়ার ইট-বালু ব্যবসায়ী সেলিমের সঙ্গে রাত কাটানোর জন্য রেশমাকে প্রস্তাব দেয় সেতু। রেশমাকে রাজী করাতে নানা ভাবে ফুসলিয়ে বিয়েসহ টাকা-পয়সার লোভও দেখায় সে। কিন্তু সে প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় রেশমা’র উপর নেমে আসে মারধরসহ নির্যাতণের খর্গ। ক’দিন মার খেয়ে এক সময় মার সইতে না পেরে রাজী হয়ে যায় রেশমা। গত বছর ৪ মার্চ রাতে সেতুর সহযোগিতায় ওই বাড়িরই একটি কক্ষে ৭দিন আটকে রেখে রেশমাকে জোর পূর্বক ধর্ষণ করে ইট-বালু ব্যবসায়ী সেলিম। এ ভাবে সপ্তাহ খানেকের বেশি প্রতি রাতেই সেলিম তাকে ধর্ষণ করে বলে জানায় রেশমা।
রেশমা আরও জানায়, এরই এক পর্যায়ে দেশে আসেন সেতুর বাবা সৌদি-প্রবাসী মিরাজ দাড়িয়া। সেতুর মা জেসমিন বেগম তখন অসুস্থতার জন্য গোপালগঞ্জ আড়াই’শ বেড জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি থাকার কারণে সেতু তার মাকে দেখাশুনার জন্য থাকছিল হাসপাতালে। সেই ফাঁকে বাড়িতে রেশমাকে একা পেয়ে সেতুর বাবা মিরাজ দাড়িয়াও পর পর দু’রাত রেশমাকে জোর পূর্বক ধর্ষণ করে। অন্ত:সত্ত্বা হয়ে পড়ে রেশমা। বেশ কিছু দিন পর বিষয়টি জানাজানি হলে সেতু তাকে নিয়ে যায় গোপালগঞ্জ মাতৃমঙ্গল ক্লিনিকে। আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে জানা যায় সে ৬ মাসের গর্ভবতী। সেতু বাচ্চাটাকে নষ্ট করার জন্য অনেক চেষ্টা করলেও সেখানকার ডাক্তার লীভারের সমস্যা দেখিয়ে রেশমা’র অপারেশন করেনি। এরপর সেতু তার পুলিশ বন্ধু গোপালগঞ্জ থানার এস আই হায়াতুর রহমানের (বর্তমানে কোটালীপাড়া থানায়) পরামর্শে রেশমা’র বাবা শফি মাতব্বরের নামে ৩’শ টাকার স্ট্যাম্প কিনে রেশমাকে দিয়ে জোর পূর্বক স্বাক্ষর করিয়ে নেয় এবং রেশমা’র বাবাকে খবর দিয়ে এনে গোপালগঞ্জ পুলিশ লাইন মোড়ে গিয়ে তাকে তার বাবার হাতে তুলে দিয়ে ভিডিও করে রাখে। হায়াতুর ছাড়াও মামুন, সাইফুল ও তন্ময়সহ বেশ কয়েকজন দারোগার সঙ্গে সেতুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলেও সাংবাদিকদের কাছে জানায় রেশমা। যদিও এসআই হায়াতুর রহমান সাংবাদিকদের কাছে সেতু’র বাড়িতে দু’দিন গিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন এবং বলেছেন, সেতু’র বাড়ির সন্নিকটে অন্য একটি ব্যাপারে তদন্ত করতে গিয়েছিলেন। তখন কাজের ফাঁকে তিনি অল্প সময়ের জন্য সেতু’র বাড়িতে গিয়েছিলেন।
রেশমা জানায়, বাড়িতে যাওয়ার পর রেশমা’র অন্ত:সত্বার বিষয়টি পরিবারের লোকজন সহজেই বুঝতে পারে। পরে কোন কুল-কিনারা না পেয়ে সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে ২৬ দিন পর রেশমা আবারও ফিরে আসে গৃহকত্রী সেতু’র কাছে। কিন্তু সেতু তাকে বাড়িতে উঠতে না দিয়ে হুমকি-ধামকি দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এক পর্যায়ে সেতু’র চাচাতো মামা লিপন মোল্লা রেশমাকে ক্ষণিককালের জন্য প্রতিবেশী দুবাই প্রবাসী হারুন মোল্লার বাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে যায়। ওই বাড়িতে আশ্রয় পাওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া পর্যন্ত রেশমা সেখানেই অবস্থান করে। এরই মধ্যে রেশমা এ ব্যাপারে গোপালগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে ধর্ষক সেলিম (৩৫) ও মিরাজ দাড়িয়া (৪৫) এবং ধর্ষণে সহায়তাকারী গৃহকত্রী সেতু বেগমের বিরুদ্ধে একটি মামলা (নং- ৩/২০১৮) দায়ের করে।
রেশমা আরও জানায়, আগে থেকেই সেতু ও সেলিম তাকে নানা ভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছিল। মামলা দায়েরের পর তাদের হুমকি-ধামকি আরও বেড়ে যায়। সেতু তার ওই সকল পুলিশ বন্ধুদের দিয়েও তাকে নানা ভয়ভীতি দেখিয়েছে। এর মধ্যেই সে অসুস্থ হয়ে পড়লে আশ্রয়দাতাদের সহযোগিতায় রেশমা’র বাবা-মা তাকে ১০ জানুয়ারি গোপালগঞ্জ আড়াই’শ বেড জেনারেল হাসপাতালে এনে ভর্তি করে। আশ্রয়দাতাদের বাড়ি থেকে হাসপাতালে এসে রেশমা জানায় আরও এক নতুন তথ্য। আশ্রয়দাতাদের বাড়ির মেঝ ছেলে ইয়াসিনও নিয়মিত প্রতিবেশি সেতু’র বাড়িতে যাতায়াত করত এবং সে সুযোগে ইয়াসিনও রেশমা’র সঙ্গে বহুবার শারিরীক-সম্পর্ক করেছে। কিন্তু অন্ত:সত্ত্বার বিষয়টি জানাজানি হলে অবস্থা বেগতিক দেখে ইয়াসিন তড়িঘড়ি করে সৌদি আরব চলে যায়। অবশেষে রবিবার রেশমা জন্ম দেয় সেই কন্যা সন্তান। যার এখনও মেলেনি কোন পিতৃ পরিচয়।
মা’ রেশমাকে দেখতে হাসপাতালে গেলে হাসপাতালের বেডে রেশমা তার সদ্যজাত কন্যা সন্তানকে জড়িয়ে ধরে শুধু এটুকুনই বলে, এরপর আমি কোথায় যাবো, কোথায় গিয়ে উঠবো, কিছুই বুঝতে পারছি না। এ সমাজে আমার ঠাঁই না হলে আমার সন্তানেরই বা কী হবে? সুষ্ঠু বিচার চাই আমি, সুন্দর ভাবে বাঁচতে চাই আমি।
গোপালগঞ্জ আড়াই’শ বেড জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাঃ ফরিদুল ইসলাম বলেন, রেশমা’র ব্যাপারে আমরা সব জেনেছি। সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে হাসপাতালে তার চিকিৎসার সকল দায়িত্ব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিয়েছে। সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া পর্যন্ত সে এবং তার নবজাতক কন্যা সন্তান হাসপাতালেই থাকবে।
এদিকে, সেতু ও সেতুর মায়ের সাথে কথা বলতে বাড়িতে গিয়েও তাদের কাউকেই পাওয়া যায়নি। সেতু’র মোবাইল ফোনে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
সেলিম শেখের সঙ্গে সাংবাদিকদের কথা হলে তিনি ঘটনার সত্যতা অস্বীকার করে বলেন, এসব মিথ্যা। আমার অনেক শত্রু আছে, তারা আমার বিরুদ্ধে এসব ষড়যন্ত্র করছে। আর ইয়াসিনের মা জেসমিন বেগম অভিযোগ করে বলেছেন, সেতু ও সেলিম পুলিশের সঙ্গে হাত করে আমার ছেলেকে ফাঁসাতে চাইছে। রেশমা’র মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সাইফুল দারোগা হাসপাতালে এসেছিল। তারা রেশমা’কে দিয়ে এখন এসব বলাচ্ছে।
মামলার বর্তমান তদন্ত-কর্মকর্তা গোপীনাথপুর পুলিশ ফাঁড়ির ওসি হযরত আলী বলেন, মামলাটির তদন্ত চলছে। মঙ্গলবার ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রেশমা’র ১৬৪ রেকর্ড হয়েছে। পুলিশ প্রতিটি বিষয় ঘেটে দেখছে। আমরা চাইবো, যা’তে রেশমা সুষ্ঠু বিচার পায় এবং তার কন্যা-সন্তানটিও পিতৃ-পরিচয় পায়। সে জন্য প্রয়োজনে ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে।