ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে : এক বছরে ৮৪৮ জন শনাক্ত-শিশু ২৭

প্রকাশঃ ২০১৮-০২-০৪ - ১১:০৭

কামরুল হোসেন মনি : খুলনা বিভাগে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাড়ছে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুর সংখ্যাও। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যান্সার ইউনিটে গত এক বছরে নতুন করে ৮৮৪ জনকে ক্যান্সারের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে শিশুর সংখ্যা রয়েছে ২৭ এর মতো। আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের। এর ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ওই সব পরিবারের। এরকম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আজ রোববার পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘আমরাই পারি, আমিও পারি’।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সার ইউনিট সূত্র মতে, ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত খুলনা বিভাগে বিভিন্ন স্থান থেকে ক্যান্সার আক্রান্ত ১ হাজার ৭৫৬ জনকে কেমোথেরাপী দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে পুরুষ ৭৮৪ জন ও মহিলা রয়েছে ৯৭২ জনের মতো। এছাড়া ২০১৮ সালের জানুয়ারি ৩১ পর্যন্ত ১৯৮ জন ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যক্তিকে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যান্সার ইউনিটের রেডিওথেরাপী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ মোঃ মুকিতুল হুদা বলেন, বর্তমানে মহিলারা ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এছাড়া পুরুষদের ক্ষেত্রে হেড নেক ও লাংস ক্যান্সার আক্রান্ত বেশি। ২০১৭ সালে পুরুষ ও মহিলা মিলে ৮৮৪ জনকে ক্যান্সারের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে যার মধ্যে শিশু সংখ্যা রয়েছে ২৭। তিনি বলেন, খুলনায় ক্যান্সারের জন্য রেডিওথেরাপি স্থাপন করা হলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে পেতে। ক্যান্সারে আক্রান্ত অধিকাংশই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবার। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘আমরাই পারি, আমিও পারি’। দিবসটি উপলক্ষে মহিলাদের ব্রেস্ট ক্যান্সারের ওপর একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে।
ক্যান্সার ইউনিটের সিনিয়র স্টাফ নার্স লতিফা খাতুন বলেন, ২০১৭ সালে নতুন করে আক্রান্ত ৮৪৮ জন ক্যান্সারের রোগীকে কেমোথেরাপী দেওয়া হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝিনাইদহ, যশোর, বরিশাল ও পিরোজপুর এলাকার সংখ্যা বেশি। সোম, মঙ্গল ও বুধবারে ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা প্রদান করা হয়। এছাড়া অন্য দিনগুলোতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কেমোথেরাপী দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকে সময়মতো থেরাপী দিতে পারেন না। রোগীর শরীরের অবস্থা দিনকে দিন অবনতির দিকে চলে যায়। ক্যান্সারের সিমটম বুঝে সর্বনি¤œ ৮-৯ হাজার থেকে দেড় লাখ পর্যন্তও কেমো দিতে খরচ হচ্ছে।
কথা হয় ওই দিন হাসপাতালে কেমোথেরাপী নিতে আসা বৃদ্ধ আকরাম হোসেনের সাথে। নগরীর খালিশপুর হাউজিং এলাকার বাসিন্দা তিনি। পেশায় তিনি ছিলেন দিনমজুর। ২০১৭ সালে ১৮ নভেম্বর তার গলায় মরণব্যাধী ক্যান্সার শনাক্ত করা হয়।
আকরামের মেয়ে শিল্পী খাতুন বলেন, খেয়ে না খেয়ে বাবার চিকিৎসা ব্যয় করা হচ্ছে। বাবার অসুস্থতার কারণে তিনি দর্জির কাজও করতে পারছেন না। তিনি প্রতি কেমোথেরাপীতে বিভিন্ন টেস্ট বাদে ওষুধে ৬-৭ হাজার টাকা লেগে যাচ্ছে।
অপর রোগী মোঃ শফিকুল ইসলাম জানান, যশোরের কেশবপুর এলাকার বাসিন্দা। তিনি ওই এলাকায় মসজিদের ইমামতি করতেন। গত ২৭ নভেম্বর তার গল ব্লাডারে ক্যান্সার শনাক্ত করা হয়। এই পর্যন্ত তিনি ৪ বার কেমো দিয়েছেন। প্রতি কেমোতে ৪০ হাজার টাকার ওপরে লেগে যাচ্ছে।
সূত্রে জানা যায়, অনেকে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর এখান থেকে কোমো থেরাপি নিয়ে যান। অনেকের ক্যান্সার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে যাওয়ার কারণে তাদেরকে কেমো থেরাপির পাশাপাশি রেডিও থেরাপির প্রয়োজন হয়। অনেক সময় যেসব রোগীদের শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ তাদেরকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওখানে কেউ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলেও আমরা তা জানতে পারিনা। যার কারণে অনেক সময় ক্যান্সারে আক্রান্ত মারা যাওয়ার রোগীর পরিসংখ্যান করা হয় না। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এর আগে ২০১৪ সালের ২০ অক্টোবর নতুন পুরাতন মিলিয়ে মোট ১৩৬ জন ক্যান্সার রোগীকে কেমো থেরাপী দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে ৮৩৯ জন, ২০১৬ সালে ১ হাজার ওপরে। ২০১৪ সালে ৯ জন শিশু ক্যান্সার আক্রান্ত হন। এর মধ্যে মারা গেছেন ২ জন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্যান্সার আক্রান্ত হয় শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরণীরা। এদের মধ্যে কোলন ও লিভার ক্যান্সার বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোমল পানীয়র কারণেও ক্যান্সার হচ্ছে। এই কোমল পানীয়র মধ্যে অসিলা টক্সিন নামের একটি উপাদান থাকে। এটি লিভার ক্যান্সার সৃষ্টি করে। বর্তমান সময়ে নাক, কান, গলা ও ফুসফুসের ক্যান্সারের সংখ্যা বেশি। মহিলাদের ব্রেস্ট ও জরায়ুর মুখে ক্যান্সার হয়। শিশুদের মধ্যে লিউকোমিয়া ও চোখের ক্যান্সার বেশি হয়। কেননা গর্ভবতী মা কেমিক্যালযুক্ত খাবার গ্রহণ করে। এছাড়া পরিবেশগত কারণে ক্যান্সার আক্রান্ত হয় শিশুরা। যারা ধূমপান করে, তামাক খায় তাদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। স্বামী ধূমপান করলে স্ত্রী পরোক্ষ ধূমপানের কারণে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়। স্ত্রীদের জরায়ু ও মূত্রথলিতে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে বেশি। এদিকে ফুসফুস ক্যান্সারের ৯০ শতাংশ কারণ ধূমপান। দেশে এ রোগে আক্রান্তদের ৬০-৭০ হাজার বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। ক্যান্সার এটি অতন্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসা। গরিব ও মধ্যবিত্তের পক্ষে চিকিৎসা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব রয়েছে।