বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া ১১টায় এ রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশীদ। রায়ে বিচারক বলেন, নুসরাতের মর্যাদা রক্ষার লড়াই একটি ইতিহাস।
আইনজীবী ও গণমাধ্যম কর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বিচারক বলেন, মিডিয়ার কারণেই নুসরাতের ঘটনার ব্যাপকতা ফুটে উঠেছে। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলেও মন্তব্য করা হয় রায়ে।
এছাড়া বিচারক আরো বলেন, সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে এতো আলোচিত মামলার রায় শেষ করা কঠিন কাজ।
গত ২৭শে মার্চ, সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের দায়ে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে আটক করে পুলিশ। সিরাজ গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার পক্ষে নামে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তার মুক্তি দাবিতে মানববন্ধনেও সক্রিয় ছিল মাদ্রাসার কিছু শিক্ষার্থী।
মামলা তুলে নিতে ক্রমাগত হুমকিও দেওয়া হচ্ছিল বলে নুসরাতের পরিবারের অভিযোগ।পরে ৬ই এপ্রিল, ওই মাদ্রাসা কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয় অধ্যক্ষের সহযোগীরা।
অগ্নিদগ্ধ নুসরাতকে ঢাকায় এনে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছিল; টানা পাঁচ দিন যন্ত্রণা সহ্য করে ১০ এপ্রিল মারা যান তিনি।
৭ এপ্রিল নুসরাত ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসকদের কাছে মৃত্যুকালীন জবানবন্দি দেন, যাতে তিনি অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যান।
নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার দুদিন পর ৮ এপ্রিল তার ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান আটজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামি করে হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। নুসরাতের মৃত্যুর পর এটি হত্যা মামলায় পরিণত নেয়।
নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডে দেশজুড়ে সৃষ্টি হয় তোলপাড়। বিক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষ। দাবি ওঠে দ্রুততম সময়ে আসামিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের।
একে একে গ্রেপ্তার হয় স্থানীয় দুই বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীন ও মাকসুদ আলমসহ ২১ জন। পরে ৩৩ কার্যদিবসে তদন্ত শেষ করে ২৯ মে মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে ১ নম্বর হুকুমের আসামি করে ১৬ জনের নামে ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেসটিগেশান (পিবিআই)।
২ নম্বর এজাহারভুক্ত আসামি নুর উদ্দিন, ৩ নম্বর আসামি শাহাদাত হোসেন শামীম, ৪ নম্বর আসামি পৌর কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ, ৫ নম্বর এজহারভুক্ত আসামি সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, ৬ নম্বর আসামি জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন, ৭ নম্বর আসামি হাফেজ আব্দুল কাদের, শিক্ষক আবছার উদ্দিন ৮ নম্বর এজহারভুক্ত আসামি, ৯ নম্বর আসামি কামরুন নাহার মনি, ১০ নম্বর আসামি অধ্যক্ষের শালিকার মেয়ে উম্মে সুলতানা পপি, ১১ নম্বর আসামি আবদুর রহিম শরিফ, ১২ নম্বর আসামি ইফতেখার উদ্দিন রানা, ১৩ নম্বর আসামি ইমরান হোসেন ওরফে মামুন, ১৪ নম্বর আসামি সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও মাদ্রাসার সহ-সভাপতি রুহুল আমিন, ১৫ নম্বর আসামি মহিউদ্দিন শাকিল এবং ১৬ নম্বর আসামি মোহাম্মদ শামীম।
৩০ মে মামলাটি হাকিম আদালত থেকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।
১০ জুন অভিযোগ অভিযোহ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। এ সময় গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচজনকে অব্যহতি দেয়া হয়।
২০ জুন ১৬ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ২৭ জুন বাদীর সাক্ষ্য নেয়ার মধ্যে দিয়ে বিচারকাজ শুরু হয়।
বিচারের সময় ১৬ আসামির মধ্যে ১২ জনের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী নেয়া হয়। মোট ৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর বিচার শুরুর পর ৩০শে সেপ্টেম্বর রায় ঘোষণার দিন ঘোষণা করে আদালত।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই ইন্সপেক্টর শাহ আলম ঘটনার পর মোবাইলে আসামিদের একে অপরের সঙ্গে কথোপকথনের অডিও কল রেকর্ড, নুসরাতের ডাইং ডিক্লারেশনসহ বেশকিছু অডিও-ভিডিও আদালতে প্রজেক্টরের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন। আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে ডিজিটাল পদ্ধতির উপস্থাপন দেশে এটাই প্রথম বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
ফেনীর পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট হাফেজ আহমেদ বলেন, “এ রায়ের দিকে সারা বাংলাদেশের মানুষ তাকিয়ে আছে। রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলা সকল সন্দেহের উর্ধ্বে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। আমরা আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাশা করছি। “
নুসরাত হত্যা মামলার মত অন্যান্য আলোচিত মামলাগুলোকেও গুরুত্ব দিলে বিচার ব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থা বাড়বে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।