যেভাবে শহীদ হলেন রাজু

ইউনিক ডেস্ক :

তাঁরা দুজন ছিলেন হরিহর আত্মা। দুজনের পড়ার বিষয় এক, হলে থাকেন এক ঘরে—রাজনৈতিক আদর্শও এক। শহীদ মঈন হোসেন রাজুর সেই বন্ধুর নাম আবদুল্লাহ মাহমুদ খান। রাজু যেদিন গুলিবিদ্ধ হলেন, ঠিক সেই মুহূর্তেও তাঁরা ছিলেন একসঙ্গে। ২৭ বছর পরও প্রিয় বন্ধুকে হারানোর বেদনা যেন শোকাচ্ছন্ন করে রেখেছে তাঁকে। যখন ১৯৯২ সালের সেই ১৩ মার্চের কথা বলছিলেন মাহমুদ, তা যেন শোনাচ্ছিল মুখস্থ কবিতার মতো।

পরদিন সকাল নয়টায় আসার কথা বলে ১২ মার্চ সন্ধ্যায় রাজু বিদায় নিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন ক্যাম্পাসে আসতে তাঁর দেরি হচ্ছিল বলে কিছুটা সময় অপেক্ষা করে মাহমুদরা চলে যান ক্রিকেট খেলতে। সকাল ১০টা কি সাড়ে ১০টায় ক্যাম্পাসে হাজির হন রাজু। মারামারি হচ্ছে শুনে ছুটে যান মধুর ক্যানটিনে। সেখানে ছাত্রদলের কর্মীরা ছাত্রশিবিরের এক কর্মীকে মারধর করছিলেন। রাজুও জড়িয়ে পড়েন সেই মারামারির ঘটনায়। তাঁর হাত কেটে যায়।

আবদুল্লাহ মাহমুদ খান বর্তমানে ঢাকায় থাকেন, পেশায় একজন ব্যবসায়ী। তিনি বলছিলেন, ‘আমরা বেলা আড়াইটার দিকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হলে এসে দেখি, রাজুর হাতে ব্যান্ডেজ। সকালের মারামারির কথা রাজুর মুখেই শুনি।’

রাজু বাসায় যেতে চাইলেন। অসুস্থ শরীরে না ফিরে কিছুটা সময় বিশ্রাম নিয়ে যেতে বললেন বন্ধুরা। রাজু বিশ্রাম নিলেন। বিকেলে বেরোলেন চার বন্ধু—রাজু, মাহমুদ, সাইফুর রহমান ও মোস্তাফিজুর রহমান। সে বিকেলে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ছিল। কিছুক্ষণ পর রিকশায় চড়ে আসেন টিএসসিতে।

রাজু আর মাহমুদ টিএসসির ভেতরে ঘুরে এসে আবারও বাইরের প্রধান ফটকে এসে দাঁড়ান। মাহমুদ বলে যান, ‘আমরা দেখলাম ডাসে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের মধ্যে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা বচসা শুরু করেছে। একটু পর ছাত্রদল হাকিম চত্বরের দিকে আর ছাত্রলীগ শামসুন নাহার হলের দিকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে সরে যেতে থাকল।’

তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পশ্চিম ফটকে পুলিশ সদস্যরা অবস্থান করছিলেন। এ ঘটনায় পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। কিন্তু তা টিএসসির সাধারণ শিক্ষার্থীদের দিকে। মুহূর্তে টিএসসি ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে যায়।

‘ঠিক সেই মুহূর্তে ঝোড়ো হাওয়া আসে। শুরু হয় বৃষ্টি। সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গোলাগুলি থেমে গেল। রাজু বন্ধুদের সঙ্গে টিএসসির প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়াল।’ যোগ করেন মাহমুদ।

বৃষ্টি থামার পর পুলিশ ডাসের কাছাকাছি অবস্থান নেয়। কিন্তু সন্ত্রাসী দুই দলের সদস্যরা তখনো অবস্থান করছিল শামসুন নাহার হলের সড়কদ্বীপ আর হাকিম চত্বরের দিকে।

এদিকে পুলিশ অস্ত্রধারীদের কিছু না বলে উল্টো সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সরে যেতে বলে। তখন রাজু ও তাঁর বন্ধুরা ডাসের পূর্বদিকে টিএসসির দেয়ালের কাছে এসে দাঁড়ান। পুলিশের রমনা থানার তৎকালীন ওসি তাঁদেরও সরে যেতে বলেন, ‘তোমরা সরে যাও, আমরা দেখছি।’

রাজু প্রতিবাদী উত্তর দিয়ে বসেন পুলিশ কর্মকর্তার উদ্দেশে, ‘আপনারা কী দেখছেন তা তো আমরা সবাই দেখলাম। আপনার দুই পাশে থাকা সন্ত্রাসীদের কি চোখে পড়ছে না?’ পুলিশ কর্মকর্তা রাজুর দিকে আঙুল তুলে অন্য পুলিশদের আদেশ করতে থাকেন, ‘এই ছেলেকে ধর।’ রাজু উত্তেজিত হয়ে নিজের বুকের শার্টে হাত ধরে বলেন, ‘ধর আমাকে’।

মাহমুদ সেই উত্তপ্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেন। তিনি রাজুকে টেনে নিয়ে আসেন টিএসসির ঠিক মাঝখানটায়। রাজু তখন রহিমের (তাঁদের সহপাঠী) দিকে আঙুল তুলে আদেশ করলেন, ‘স্লোগান ধর রহিম।’ রহিম জিজ্ঞেস করলেন কোন সংগঠনের ব্যানারে মিছিলটা হবে। রাজু বললেন গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের নামে স্লোগান দিতে।

শুরু হলো রাজুদের মিছিল। ‘সামনের সারিতে ছিলাম আমরা পাঁচজন। আমার ডানে রাজু। ঠিক ভাস্কর্যের মতোই হাতে হাত ধরে আমরা এগোচ্ছিলাম।’ বলেন মাহমুদ।

তাঁদের ১০-১২ জনের মিছিলটি টিএসসির পূর্ব গেট ধরে ডাস (ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্ন্যাকস) ঘুরে হাকিম চত্বরের পাশ দিয়ে বর্তমান রাজু ভাস্কর্য ঘুরে টিএসসিতে অবস্থান নেয়। তখন মিছিল বিশাল আকার ধারণ করেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এসে যোগ দিয়েছে। এরপর আবার ঘুরে টিএসসির পশ্চিম দিকের সিঁড়িঘরের সামনে মিছিলটি থামে। নেতা-কর্মীরা সমাপনী বক্তব্য দিতে থাকেন।

ঠিক সেই মুহূর্তে আবার গোলাগুলি শুরু হয়। রাজু ও মিছিলের সঙ্গীরা সিদ্ধান্ত নেন সাহসী প্রতিবাদের। এগিয়ে যান আবারও একই পথে। স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্য অতিক্রম করে কিছু দূর যাওয়ার পর এক রাউন্ড গুলি হয়। রাজু চিৎকার করে মাহমুদকে বলে ওঠেন, ‘ওরা মিছিলের ওপর গুলি করেছে।’ পরমুহূর্তে আরেক রাউন্ড গুলি। রাজু তাঁকে টান দিলেন। মাহমুদ ভাবলেন, রাজু শুয়ে পড়ার জন্য তাঁকে টানছেন। মাহমুদ হাঁটু গেড়ে বসতেই রাজু হেলে পড়লেন মাহমুদের কাঁধে। তাঁর চোখ জোড়া তখন উল্টে গেছে।

মাহমুদ সেই করুণ মুহূর্তের কথা বলে যান ধরা গলায়, ‘রাজুকে জড়িয়ে ধরে দেখলাম ওর হাত বেয়ে রক্ত ঝরছে। মুহূর্তেই বুঝলাম রাজু গুলিবিদ্ধ।’ পাশেই ছিল পুলিশ। সাহায্য চাইলেন মাহমুদ। পুলিশ উল্টো দিকে দৌড় দিল। গিয়ে তাঁদের দিকেই টিয়ার শেল ছুড়ল।

মিনিট পাঁচেক কেটে গেল। ধোঁয়া আর অন্ধকারের মধ্যেই মাহমুদ দেখতে পেলেন, ডাসের দিক থেকে দুজন এগিয়ে আসছেন। রাজুকে তাঁরা কোলে করে রিকশায় তুলে নিলেন। গুলিবিদ্ধ রাজুকে নিয়ে ছুটলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

ফোনের অপর প্রান্তে গলা ধরে এল মাহমুদ খানের—মঈন হোসেন রাজুর প্রিয় বন্ধু। তাঁর সেই বন্ধু হাসপাতাল থেকে আর কখনো ফেরেননি। তিনি আর কোনো মিছিলে নেতৃত্ব দেননি। কিন্তু সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে উচ্চকিত মানুষ ঠিকই অনুভব করেন রাজুর প্রেরণা, উপস্থিতি।

ভাস্কর শ্যামল চৌধুরীর হাতে তৈরি হচ্ছে রাজু ভাস্কর্য তৈরি হলো সন্ত্রাসবিরোধী ভাস্কর্য

রাজুর স্মরণে এবং সন্ত্রাসবিরোধী চেতনা ধরে রাখার প্রত্যয়ে তৈরি হয় সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য। এই ভাস্কর্য নির্মাণ করতে গিয়েও নানামুখী বাধাবিপত্তির মুখে পড়তে হয়। তবে সব চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৯৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করা হয়। ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী এটির নকশাকার। রাজু ভাস্কর্যে আটজনের অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মুনীম হোসেন রানা, শাহানা আক্তার শিলু, সাঈদ হাসান তুহিন, আবদুল্লাহ মাহমুদ খান, তাসফির সিদ্দিক, হাসান হাফিজুর রহমান সোহেল, উৎপল চন্দ্র রায় ও গোলাম কিবরিয়া রনির প্রতিকৃতি ব্যবহার করে এগুলো তৈরি করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

You may use these HTML tags and attributes: <a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>