আমার সন্তানের পিতৃ পরিচয় চাই

প্রকাশঃ ২০১৮-০১-২৫ - ১৬:৩১

গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি : গোপালগঞ্জে ধর্ষনের শিকার গৃহকর্মী রেশমা আক্তার (১৯) একটি কন্যা সন্তানের জম্ম দিয়েছেন। রোববার সকালে গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে সে এ কন্যা সন্তানের জম্ম দেন তিনি। ফরিদপুর জেলার সালতা উপজেলার কামারদিয়া গ্রামের দিন মুজুর শফি মাতুব্বরের মেয়ে রেশমা। ছোট বেলায় মাকে হারায়। বিমাতার সংসারে অভাব অনাটনের মধ্যে তার বেড়ে উঠা। দুই বছর আগে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থানার সাব-ইন্সপেক্টর কামরুল ইসলামের বাসায় গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজের জন্য তাকে নিয়ে আসা হয়। সেখানে বেশ ভালই কেটে যাচ্ছিল তার। মুকসুদপুর থানা থেকে পুলিশ অফিসার কামরুল ইসলাম কিছু দিন পর মুন্সিগঞ্জ জেলার গজারিয়া থানায় বদলী হয়ে যান। কয়েকদিনের মাথায় কাঁচপুর ব্রীজের কাছে এক সড়ক দুর্ঘটনায় ওই পুলিশ অফিসার নিহত হন। এরপর কামরুলের স্ত্রী সেতু বেগম তার একমাত্র কন্যা ও রেশমাকে নিয়ে গোপালগঞ্জের পুকুরিয়া গ্রামে তার নানান বাড়ীতে বাবা-মায়ের কাছে চলে আসেন।
স্বামীর মৃত্যুর পর উচ্চাভিলাষী সেতু নানার বাড়ীতে থেকে বেপরোয়া জীবন যাপন করতে শুরু করেন। পুলিশ কর্মকর্তা এস আই মামুন, এস আই হায়াতুর, এস আই তন্ময়, ধর্ষক সেলিম ও ধর্ষক ইয়াসিনসহ কতিপয় যুবকের সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। ওই পুলিশ কর্মকর্তা ও যুবকরা রাত বেরাতে সেতুর বাড়ীতে যাওয়া আসা করতো। অর্থের বিনিময়ে দেহ ব্যবসায় জড়িযে পড়ে সেতু। এরমধ্যে একদিন সেতুর মাধ্যমে ধর্ষক সেলিম রেশমাকে তার সাথে মেলামেশার প্রস্তাব দেয়। তাতে সে রাজি না হওয়ায় সেলিম তাকে টাকা দেয়ার লোভ দেখায়। এতেও সে রাজি না হলে সেলিম তাকে বিবাহ করা প্রস্তাব দেয়। এভাবে সেলিম তাকে দিনের পর দিন ফুসলাতে থাকে। গত ২০১৭ সালের ৪ মার্চ রাতে সেতুর সহযোগিতায় সেতুর নানা বাড়ীতে একটি কক্ষের মধ্যে রেশমাকে আটকে রেখে জোর পূর্বক ধর্ষন করে সেলিম। এভাবে তাকে পর পর ৭দিন ওই বাড়ীতে আটকে রেখে ধর্ষন করা হয়। এরই এক পর্যায় সেতুর বাবা সৌদি প্রবাসী মিরাজ দাড়িয়া দেশে আসেন। ওই সময় গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে সেতুর মা জেসমিন বেগমের শরীরে অস্ত্রপাচার করা হয়। সে কারনে এবং মায়ের সেবা করতে দু’দিন সেতুকে হাসপাতালে থাকতে হয়। তখন রেশমা ও সেতুর বাবা মিরাজ দাড়িয়াকে ওই বাড়ীতে একা থাকতে হয়। ওই সুযোগে সেতুর বাবা মিরাজ দাড়িয়াও পর পর দু’দিন রেশমাকে ধর্ষন করে বলে জানায় রেশমা।
এছাড়াও পুকুরিযা গ্রামের বসবাসের এক পর্যায় পাশের বাড়ীর মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী হারুন মোল্লার ছেলে ইয়াসিন মোল্লার সাথে রেশমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ইয়াসিন মোল্লা প্রেমের সর্ম্পক গড়ে তুলে রেশমাকে একাধিক বার ধর্ষন করে বলেও জানায় রেশমা। একপর্যায় অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে রেশমা। বিষয়টি জানাজানি হলে এনিয়ে এলাকায় কাঁনাঘোষা শুরু হয়। গৃহকত্রী সেতু বেগম অবস্থাটের পেয়ে রেশমাকে তার বাবার বাড়ীতে পাঠিয়ে দেন। লোক লজ্ঝার ভয়ে সেখানেও থাকতে পারেনি রেশমা। ফলে সে আবার ফিরে আসে পুকুরিয়া গ্রামে। সেতু বেগম রেশমাকে বাড়ীকে আশ্রয় না দিয়ে হুমকি-ধামকি দিয়ে বাড়ী থেকে বের করে দেয়। বাড়ী থেকে বের করে দেওয়ার আগে এস আই হায়াতুরের পরামর্শে সেতুসহ ধর্ষকরা জোর করে ফাঁকা নন জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে রেশমার কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে নেয়। এ ছাড়াও মামলা তুলে নেয়ার জন্য তাকে হত্যা করে বস্তার মধ্যে ভরে নদীতে ফেলে দেয়াসহ নানান হুমকি দিচ্ছে তারা। রহস্যজনক কারনে পুলিশ নীরব থাকায় বর্তমানে রেশমার নিরাপত্তা চরমভাবে ব্যহত হচ্ছে।
ঘটনার সুষ্ঠ বিচার চেয়ে রেশমা সদর উপজেলার পুকুরিয়া গ্রামের বাদশা শেখের ছেলে ধর্ষক সেলিম (৩৫), মোমরেজ দাড়িয়ার ছেলে পিতা মিরাজ দাড়িয়া (৫০) ও ধর্ষনের সহযোগিতাকারি সেতু বেগমকে আসামী করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আদালত, গোপালঞ্জে মামলা করেছেন ফরিয়াদি রেশমা বেগম (মামলা নং-৩/২০১৮)। হাসপাতালের গাইনী ওয়ার্ডের ১৩ নম্বর বেডে রেশমা ও নবজাতক সুস্থ থাকলেও দুঃশ্চিন্তা তার পিছু ছাড়ছে না। সারাক্ষন একটি প্রশ্ন তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাহলো তার সন্তানের পিতার স্বীকৃতি। সামাজিক নানান বাধা ও লোকলজ্জায় ভয়ে তার জীবন বিপন্ন প্রায়। তারপরও সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে বেঁচে থাকতে চায় রেশমা। চাঁদের মতো ফুট ফুটে শিশুকে বুকে আগলে বুনে স্বপ্নের বীজ। নবজাতকের পিতৃত্বের স্বীকৃতিই কেবল তার একমাত্র চাওয়া।
হাসপাতালের বেডে কথা হয় রেশমার সাথে এ সময় সে জানায়, আমার দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে ধর্ষকরা আমাকে নানা ভাবে ব্যবহার করেছে। বর্তমানে ধর্ষকদের হুমকি আমার জীবনটাকে দূর্বিষহ করে তুলেছে। গোপালগঞ্জ থানার সাবেক ও বর্তমান কোটালিপাড়া থানায় কর্মরত এস আই হায়াতুর, এস আই মামুন, এস আই তন্ময়ের সাথে সেতু বেগমের সম্পর্ক রয়েছে। তাদেরকে দিয়েও আমাকে ভয় দেখানো হচ্ছে। আমি এখন কোথায় গিয়ে ওঠবো কিছুই বুঝতে পারছি না। এ সমাজে আমার কোন ঠাই হবে না। আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া কোন গতি নেই। আমি আমার কন্যা সন্তানের পিতৃ পরিচয় চাই। চাই ধর্ষকদের বিচার। ইয়াসিন মোল্লাই আমার সন্তানের পিতা। আমি আমার সন্তানের পিতৃত্বের পরিচয় চাই। চাই সমাজে আর দশটা মানুষের মতো বেঁচে থাকার অধিকার।
এ ব্যাপারে শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজের প্রফেসার ও রেশমার সিজারিয়ান অপরেশনের চিকিৎসক ডাঃ মাহমুদা জানান, রেশমা ও তার নবজাতক দু’জনেই সুস্থ আছেন।
এ ব্যাপারে মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা ও গোপীনাথপুর পুলিশ ফাঁড়ির পুলিশ পরিদর্শক হয়রত আলী জানান, ইতোমধ্যে ১৬৪ ধারায় ভিকটিমের জবানবন্দী সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে আসামীরা কেউ কেউ পলাতক আছে আবার কেউ বিদেশে অবস্থান করছে। আমরা আসামীদেরকে গ্রেফতার ও বিদেশে থাকা অন্য আসামীকে দেশে ফিরিয়ে এনে ডিএনএ পরীক্ষার ব্যবস্থা করবো। তিনি আরো বলেন, রেশমার কন্যা সন্তানের পিতৃ পরিচয় পেতে যা যা লাগবে আমরা তার সকল ব্যবস্থা করতে প্রস্তুত আছি।