উপকুলে সুগন্ধ ছড়াবে তুলশীমালা

প্রকাশঃ ২০২১-০৪-১৭ - ২১:২১

সাবরিনা বিনেত মাহবুব : পল্লীকবি জসীম উদ্দীন তার কবিতায় শালি ও বিন্নি ধানসহ বিভিন্ন জাতের বেশ কয়েকটি প্রাচীন সুগন্ধী ও উন্নতমানের ধানের উল্লেখ করেছেন। সমসাময়িক সময়ের তেমনই একটি সুগন্ধী ধান তুলশীমালা।স্থানীয় প্রজাতির বিলুপ্ত প্রায় অত্যন্ত উচ্চমানের সুগন্ধী ধানের জাত এটি। উপকুলীয় অঞ্চলের ২১টি জেলার মধ্যে এই আমন মৌসুমে সুগন্ধী তুলশীমালা ধানের প্রথম চাষ হয়েছে খুলনায়। বটিয়াঘাটা উপজেলার গুপ্তমারী গ্রামের কৃষক রণজিৎ মন্ডল নিজের ০৫ শতক জমিতে এই ধান চাষ করেছেন। প্রথমবার চাষে ফলনও পেয়েছেন আশাপ্রদ একর প্রতি ৩০ মণ।এই সফলতায় খুলনাসহ উপকুলীয় অঞ্চলে অভিজাত শ্রেনীর হিসেবে খ্যাত ‍সুগন্ধী তুলশীমালা ধান চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছেন কৃষি বিভাগ ও বিশেষজ্ঞরা।
কৃষক রণজিৎ মন্ডল জানান, তিনি দীর্ঘ সময় ধরে আমন মৌসুমে স্থানীয় জাতের ধান চাষ করেন। এই আমন মৌসুমে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা এসএম আতিয়ার রহমান শেরপুর এলাকা থেকে সুগন্ধী তুলশীমালা ধানের মাত্র ০২ কেজি বীজ সংগ্রহ করে আমাকে দেন। তিনি আমাকে সব সময় সহায়তা দিয়েছেন। আমি ধানের চারা তৈরী করে আবাদ করি। শুরু থেকেই ধানের গ্রোথ ভালো ছিল।০৫ শতক জমিতে চাষ করে দেড় মণ ধান পাওয়া গেছে। সে হিসেবে একর প্রতি ৩০ মণ ধানের ফলন হয়েছে।
তিনি আরও জানান, এই ধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ধানের ফুল আসার পর থেকে পাকা পর্যন্ত ০৫ বার রং পাল্টায়। প্রথমে হালকা সবুজ, এরপর কিছুটা অ্যাশ, এরপর হালকা জাম রং, তারপর গাড় জাম রং এবং শেষে কালো ও অ্যাশ মিলিয়ে নতুন একটি রং ধারণ করে। ধানের গাছের উচ্চতা ৫০-৫২ ইঞ্চির মতো হয়ে থাকে। ধানের চারা রোপনের পর থেকে ১১০-১২০ দিনের মধ্যে ফসল কাটা যায়। এর একটি শীষে ৯০-১২০টি ধান পাওয়া গেছে।সবটুকু ধানই বীজ হিসেবে আগামী আমন মৌসুমে লাগানোর জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। তুলশীমালা ধান দেখে অনেকেই চাষ করতেিআগ্রহ প্রকাশ করে বীজের চাহিদা জানিয়েছেন।এ বছর ৫-১০ জনকে কিছু বীজ দিয়ে চাষ সম্প্রসারণে সহযোগিতা করবো।
কৃষক রণজিৎ মন্ডলের মতে, বটিয়াঘাটার স্থানীয় রানী স্যালুট, হরকোচ, কাচড়া জাতের একেকটি ধানের আকার ও ওজনের সমান তুলশীমালা ধানের ৩টি ধান। তুলশীমালা এতোটাই ছোট আকারের এবং মনোমুগ্ধকর রং। পাকা ধানের ছড়া দেখে সত্যিই মনে হয় তুলশীর কাঠ দিয়ে গাঁথা মালার মতো বলে জানান তিনি।
খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, সারাদেশে মাত্র ২০-২৫ হাজার হেক্টর জমিতে এই ধান চাষ হয়। এর শতকরা ৫০ ভাগই আবাদ হয় শেরপুর-ময়মনসিংক অঞ্চলে। উচ্চফলনশীল না হলেও এই ধানের চালের কদর এখনও বেশি। সুগন্ধী কালোজিরা ধানের চালের চেয়েও আকারে ছোট তুলশীমালা ধানের চালের যে কোনো খাবার অত্যন্ত সুস্বাদু হয়। ধান, ধানের খড় থেকে শুরু করে মাঠময় সুগন্ধ ছড়ায়। গত আমন মৌসুমে খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার দাউনিয়াফাদ মাঠে কৃষক রণজিৎ মন্ডল প্রথমবারের মত সুগন্ধী তুলশীমালা ধান চাষ করেছেন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা এস এম আতিয়ার রহমান জানান, তিনি শখের বশে শেরপুর থেকে এই ধানের মাত্র ০২ কেজি বীজ সংগ্রহ করে কৃষক রণজিৎ মন্ডলকে দেন।জমি চাষ থেকে শুরু করে ধান কাটা পর্যন্ত সব সময়ই তিনি সাথে থেকে তত্ত্বাবধানও করেছেন।এই ধানটি লবণাক্ত ঊপকূলীয় এলাকায় হবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ ছিলো।কিন্তু বাস্তবে অনেক ভালো ফলন হয়েছে।মূলত: বিলুপ্তপ্রায় স্থানীয় জাতের সুগন্ধী তুলশীমালা ধানকে খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চাষে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এই ধানের বীজ সংগ্রহ ও চাষ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
বটিয়াঘাটা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো: রবিউল ইসলাম জানান, আমন মৌসুমে বটিয়াঘাটাসহ খুলনাঞ্চলে শতকরা ৮০ভাগই স্থানীয় জাতের ধান চাষ হয়ে থাকে। সে সব ধানও বেশ সুগন্ধীযুক্ত। তবে খুলনাঞ্চলে তুলশীমালা ধানের চাষ যেমন হয় না। তেমনি এ ধানের চালও খুব কম পাওয়া যায়। গত আমন মৌসুমে বটিয়াঘাটার গুপ্তমারী গ্রামের কৃষক রনজিত মন্ডল এ ধানের চাষ করায় ফলনও ভালো পেয়েছেন। তেমন কোন সমস্যা হয়নি। এই ধান উপকুলীয় অঞ্চলে চাষ করার জন্য উপযোগী বলে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে।তবে আগামী মৌসুমে কৃষি বিভাগের উদ্যোগে এ ধানের চাষের ট্রায়ালের ব্যবস্থা করা হবে। ট্রায়াল চাষে যদি ফলন ভালো হয় এবং বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে সুবিধাজনক হয় তাহলে কুষি সম্প্রসারণ বিভাগ উপকুলের কৃষকদের মাঝে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারনের উদ্যোগ নিতে পারে।
তিনি আরও জানান, খুলনাসহ উপকুলীয় অঞ্চলে চাষ না হলেও ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগে তুলশীমালা ধানের অনেক বেশী চাষ হয়ে থাকে। এ ধানের চাল প্রতিকেজি চাল ১২০-১৪০ টাকা দরে বিক্রি হয়। তুলশীমালা ধানের চালই দেশীয় চালের মধ্যে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হয়ে থাকে।কাজেই উপকুলীয় অঞ্চলে এ ধান চাষে কৃষকও লাভবান হতে পারবে বলে তিনি মনে করছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ময়মনসিংহ অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মো: আব্দুল মাজেদ জানান, ময়মনসিংহের বিভাগের শেরপুর জেলা ও আশপাশের কিছু এলাকায় চাষীরা শখের বসে অভিজাত পরিবারের জামাই বা আত্মীয়-স্বজন আপ্যায়নে এই সুগন্ধী ধান চাষ করে থাকেন।গত আমন মৌসুমে এ অঞ্চলে ২১ হাজার ৩০৩ হেক্টর জমিতে তুলশীমালা চাষ হয়। এর মধ্যে শেরপুর জেলায় সর্বোচ্চ ১২ হাজার ১৬ হেক্টর জমিতে চাষ হয়। হেক্টর প্রতি চালের উৎপাদন ১.৫৭ মেট্রিক টন। এ ধান চাষে উৎপাদন ও চালের দাম বেশী হওয়ায় কৃষকও অনেক লাভবান হচ্ছেন।িআশাকরি খুলনাঞ্চলের চাষীরাও আবাদ করে লাভবান হবেন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালযের এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. মোঃ মনিরুল ইসলাম জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় জাতের ধান যেন হারিয়ে না যায় সেকারনে গবেষনা করছেন।সুগন্ধী তুলশীমালা ধানও স্থানীয় একটি জাতের ধান। অত্যন্ত প্রাচীন স্থানীয় জাতের জলবায়ু সহিষ্ণু এই ধানের চাল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। এছাড়াও মূল্যবান ভিটামিন ও মিনারেলসহ অন্যান্য গুণ রয়েছে। এটি মূলত ময়মানসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় চালাবাদ হয়ে থাকে।এ ধানের চাল অনেক মিহি ও সুগন্ধী হওয়ায় অনেক ডিমান্ড রয়েছে। তিনি বলেন, খুলনাসহ উপকুলীয় অঞ্চলে আমন মৌসুমে মাটি ও পানিতে তেমন কোন লবনাক্ততা থাকে না সে কারনে এ অঞ্চলেও এ ধানের চাষ হতে পারে। গত আমন মৌসুমে বটিয়াঘাটা উপজেলার একজন চাষী খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা আতিয়ার রহমানের সহযোগীতায় এ ধানের বীজ সংগ্রহ করে চাষ করেছেন। ফলনও ভালো পেয়েছেন বলে জানা গেছে। এটি খুলনাসহ উপকুলীয় অঞ্চলের চাষের উপযোগী বলে মনে হচ্ছে। তবে এ ধানের বিষয়ে আরেকটু গবেষনা হওয়া দারকার। এই তুলশীমালা ধানের কোন গুনাগুন পরিবর্তন না করে ফলন বৃদ্ধি ও জীবনকাল কমানো যায় সে বিষয়ে তিনি আগামী বছরের আমন মৌসুমে গবেষনা শুরু করবেন।টিস্যু কালচার ও গবেষনা প্লটের মাধ্যমে তিনি কাজ করবেন এবং আশানুরুপ ফলাফল পেলে কৃষক ও দেশও লাভবান হবে। যা হতে পারে উপকুলীয় অঞ্চলের নতুন সম্ভাবনা বলে মনে করেছেন এই গবেষক।