একাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটের হাওয়া গোপালগঞ্জ ১

প্রকাশঃ ২০১৮-০৩-২৭ - ১৮:২০

গোপালগঞ্জ : গোপালগঞ্জ-১ (মুকসুদপুর ও কাশিয়ানী) আসন আওয়ামী লীগের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মভূমি গোপালগঞ্জের নির্বাচনী আসনের সবকটির ন্যায় এ আসনেও সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই বিপুল ভোটে বার বার বিজয়ী হয়ে আসছেন। আওয়ামীলীগের এ ঘাঁটিতে অন্যান্য দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা মাত্র। আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির কমবেশী তৎপরতা থাকলেও অন্যান্য ছোট ছোট দলগুলোর তৎপরতা তেমন চোখে পড়ার মতো নয়। এছাড়া জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের তৎপরতা একেবারেই নেই।
১৯৯৬ সালের জুন থেকে প্রতিটি নির্বাচনেই এ আসনে এমপি নির্বাচিত হয়ে আসছেন আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্ণেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান। আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে তিনি বানিজ্য এবং বে-সামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। তিনি তার নির্বাচনী এলাকায় বেশ উন্নয়ন মূলক কাজ করেছেন। দলের নেতা-কর্মী ও এলাকার ভোটারদের সাথে তার রয়েছে নিবিড় যোগাযোগ। প্রায়ই এলাকায় আসেন তিনি এবং বিভিন্ন জনহিতকর কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। সাধারন মানুষ তাকে ক্লিন ইমেজের নেতা হিসেবেই জানেন বলে নেতা-কর্মীদের সাথে আলাপকালে জানা যায়। তবে গত উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এবং দলের বিভিন্ন কমিটি গঠনসহ নানান কারণে বর্তমানে ফারুক খানের ক্লিন ইমেজে কিছুটা ছেদ পড়েছে। অসন্তোষ দেখা দিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যে। ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের কেউ কেউ নিজেদের রাজনীতি থেকে গুটিয়ে রেখেছেন। বিষয়গুলো ইতিমধ্যে দলের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিতেও এসেছে বলে ক্ষুদ্ধ নেতা-কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়। এ অবস্থায় আগামী নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়নে আওয়ামীলীগে চমক আসতে পারে বলে লোকমুখে গুঞ্জন রয়েছে।
অন্যদিকে, নেতাকর্মীদের কেউ কেউ বলছেন, বঙ্গবন্ধুর ছোট কণ্যা শেখ রেহানা এ আসন থেকে নির্বাচন করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে বর্তমান এমপি লে. কর্ণেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান ঢাকার একটি আসনের প্রার্থী হতে পারেন। তবে সুনির্দিষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। তারা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা এ আসনে নির্বাচন করলে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন করে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া আওয়ামীলীগের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য মুকুল বোস। সংস্কারবাদী নেতা নেতা হওয়ার কারনে দীর্ঘ সময় রাজনীতির বাইরে ছিলেন তিনি। সম্প্রতি তিনি আবারও রাজনীতিতে সরব হয়েছেন। দলীয় পদ বঞ্চিত, ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত ও পরাজিত প্রার্থীরাসহ দলের একটি অংশ তার সঙ্গে রয়েছে বলে জানা গেছে।
সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি এ্যাডভোকেট উম্মে রাজিয়া কাজল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ, জেলা আওয়ামীলীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক ও এ আসনের সাবেক সাংসদ মরহুম কাজী আব্দুর রশীদের বড় ছেলে কাজী হারুন অর রশীদ মিরন, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের দৌহিত্র ব্যারিস্টার আলী আসিফ খান, জেলা ছাত্রলীগের আশির দশকের মাঠ দাপানো নেতা বর্তমানে আওয়ামীলীগ যুক্তরাষ্ট্র শাখার সদস হিন্দোল কাদির বাপ্পা, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রভাষক আরিফা রহমান রুমা, যুবলীগের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ আতিয়ার রহমান দিপু ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় অর্থ বিষয়ক সম্পাদক কে এম মাসুদুর রহমান মাসুদ দলের কাছে মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে।
সাবেক মন্ত্রী লে. কর্ণেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান জানান, এ আসনে চারবারের এমপি তিনি। সব সময়ই তিনি নির্বাচনী এলাকার জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। তিনি এলাকায় ব্যাপক উন্নয়নে জন্য কাজ করেছেন। আগামী নির্বাচনেও তিনি এ আসনে দলের মনোনয়ন চাইবেন এবং জননেত্রী শেখ হাসিনা তাকেই মনোনয়ন দেবেন বলে তিনি আশাবাদী।
মুকুল বোস দলের কাছে মনোনয়ন প্রত্যাশা করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই আগামী নির্বাচনে ত্যাগী ও পরীক্ষিত কর্মীদের মূল্যায়ন করবেন।
এ্যাডভোকেট উম্মে রাজিয়া কাজল জানান, ভোটারদের সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। দলের জন্যও তার অনেক ত্যাগ রয়েছে। তাই তিনি আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চাইবেন।
অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ মনোনয়ন চাইবেন বলে প্রত্যাশার কথা জানান।
কাজী হারুন অর রশীদ মিরন জানান, এ আসনে কোনো উন্নয়ন হয়নি। দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতারা বঞ্চিত হয়েছেন। এ অবস্থায় তিনবারের এমপি কাজী আবদুর রশীদের ছেলে হিসেবে মনোনয়ন দিলে তিনি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন।
হিন্দোল কাদির বাপ্পা বলেন, রাজনীতি করতে গিয়ে জেল জুলুমসহ নানান অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। দলের দুঃসময়ে নেতা-কর্মীদের সাথে নিয়ে জিয়া ও এরশাদের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। বর্তমানে আমেরিকায় আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ভুমিকা পালন করছেন। এসব বিবেচনা করে এ আসনে তিনি দলীয় মনোনয়রন পাবেন বলে তিনি আশাবাদী।
আরিফা রহমান রুমা জানান, সংসদে আইন প্রণয়ন ও নীতিনির্ধারণের জন্য শিক্ষিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেয়া উচিত। তিনি দলের মনোনয়ন চাইবেন।
শেখ আতিয়ার রহমান দিপু জানান, গত ২০ বছর যাবত তিনি এ আসনের মানুষের সঙ্গে রয়েছেন। ভোটারদের সঙ্গেও তার যোগাযোগ রয়েছে। মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী এই নেতা।
কে এম মাসুদুর রহমান মাসুদ বলেন, দলের প্রার্থিতার জন্য তিনি গত ১০ বছর রাস্তা-ঘাটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন করছেন। এলাকাবাসীর কাছ থেকেও ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন। আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন তিনি।
আওয়ামীলীগের মনোনীত প্রার্থী বিপুল ভোটে নির্বাচিত হলেও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছেন প্রতিটি নির্বাচনে। এ আসনে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা অনেক দুর্বল। দলের নেতাকর্মীরা প্রায় সময়ই নিষ্ক্রিয় থাকেন। তা ছাড়া অতীতে কোনো নির্বাচনে আওয়ামীলীগের সঙ্গে সামান্যতম প্রতিদ্বন্দ্বিতাও গড়ে তুলতে পারেনি বিএনপি। তবুও আগামী নির্বাচন নিয়ে চলছে তাদের নানা পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি। গণসংযোগ, সদস্য সংগ্রহসহ নানা কার্যক্রম। বিএনপি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য অনেকেই আগ্রহী। আগামী নির্বাচনে তাই শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দলীয় মনোনয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী বিতর্কিত নির্বাচনে জয়ীও গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি এফ ই শরফুজ্জামান জাহাঙ্গীর, দলের কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলিম ও কেন্দ্রীয় সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ জায়নুল আবেদীন মেজবাহ।
জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এফ ই শরফুজ্জামান জাহাঙ্গীর জানান, ১৯৯৬ সাল থেকে তিনি এ আসনে দলীয় কার্যক্রম দেখাশোনা করছেন। তিনি ১৯৭৯ ও ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি গোপালগঞ্জ-২ আসন থেকে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দিতা করেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারীর সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী হিসেবে গোপালগঞ্জ-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এখানকার মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে। তিনি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
সেলিমুজ্জামান সেলিম জানান, তিনি ছাড়া দলের কোনো নেতা সাংগঠনিক কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন না। তিনি সব সময়ই নেতা-কর্মীদের পাশে রয়েছেন। নবম সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। আগামী নির্বাচনেও দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলীয় নেতারা তাকে এ আসনে মনোনয়ন দিলে তিনি নির্বাচন করবেন।
সৈয়দ জায়নুল আবেদীন মেজবাহ জানান, তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তিনি সব সময়ই নেতাকর্মীদের পাশে থেকেছেন। তাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হলে এ আসনে বিএনপি সম্মানজনক ভোট পাবে বলে তার বিশ্বাস।
জাতীয় পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থী দীপা মজুমদার জানান, তিনি এ আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পেয়ে দশম সংসদে প্রতিদ্বন্দিতা করেছেন। আগামী নির্বাচনেও তিনি জাতীয় পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। তিনি ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।
এছাড়া কাশিয়ানী উপজেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান শেখ মুন্নু, জাতীয় কৃষক পার্টির সহ-সভাপতি রীতা মজুমদার, মুকসুদপুর উপজেলা জাসদের (ইনু) সভাপতি আজম শরীফ ও ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।
মুকসুদপুর উপজেলার ১টি পৌরসভা, ১৬টি ইউনিয়ন ও কাশিয়ানী উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত গোপালগঞ্জ-১ আসন। এই আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ১০ হাজার ৩৩৫। এর মধ্যে নারী ভোটার ১ লাখ ৫৫ হাজার ২৮২ ও পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫৫ হাজার ৫৩ জন।
গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব আলী খান বলেন, গোপালগঞ্জের মানুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আদর্শে বিশ্বাসী ও একক ভাবে নৌকার সমর্থক। আগামী সংসদ নির্বাচনেও দলের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবেন এবং শেখ হাসিনার নেত্রীত্বে পুনরায় সরকার গঠন করে হ্যাট্রিক করবে। সেই সাথে উন্নয়নের ধারা অব্যহত রাখবেন।