মো:নজরুল ইসলাম, ঝালকাঠি:: বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী জনপদ ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্ত্তিপাশা। এখানে জন্মগ্রহণ করেছেন ঐতিহাসিক রুহিনী কুমার রায় চৌধুরী, পশ্চিম বাংলার বামফ্রন্টের সাবেক চেয়ারম্যান শৈলেন দাস গুপ্ত, সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত, অক্সেফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ঐতিহাসিক তপন রায় চৌধুরীর মতো মানুষ। রয়েছে বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন। যার মধ্যে অন্যতম হলো কীর্ত্তিপাশা জমিদার বাড়ি। কিন্তু যথাযথ সংরক্ষণ ও সংশ্লিষ্টদের অবহেলার কারণে দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এসব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। আর অবৈধ দখলের মাধ্যমে ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন করে ফেলছে একটি অসাধু চক্র। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বিক্রমপুরের জমিদারদের একাংশ কীর্ত্তিপাশায় জমিদারি পত্তন করে। তাদের প্রচেষ্টায় এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় বিদ্যালয়, হাসপাতাল, মঠ, মন্দির, নাট্যশালাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ফলে কীর্ত্তিপাশা শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চার তীর্থস্থানে পরিণত হয়।
প্রতি বছর বহু গুণী মানুষের স্মৃতিধন্য এ স্থান পরিদর্শনে আসেন দেশী-বিদেশী পর্যটকরা। এসেছেন বহু বিখ্যাত মানুষও। কিন্তু জমিদারদের এ বিশাল সম্পত্তি আত্মসাতের জন্য একটি চক্র অনেক আগে থেকেই তৎপরতা চালিয়ে আসছে। জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করেছে ভুয়া দলিল। এরই মধ্যে একটি ভুয়া চুক্তিনামার মাধ্যমে আদালত থেকে জমিদার বাড়ির ৩৮ একরেরও বেশি জমি ডিক্রি করিয়েছে তারা বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই ঘটনায় আলম হাওলাদার ও আনিচ হাওলাদার নামে দুইভাকে ৭ বছরের কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত।
কিন্তু তার পরেও দখল চেষ্টা চলছে। আর এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই এসব গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন হারিয়ে যাবে বলে জানিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা।
কীর্ত্তিপাশা জমিদার বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত কমলীকান্দার নবীন চন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক স্বপন সেন গুপ্ত, স্থানীয় এনজিও কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান, কীর্ত্তিপাশা ইউপি চেয়ারম্যান শুক্কুর মোল্লাসহ স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন- ঝালকাঠি জেলার কীর্ত্তিপাশা একটি প্রাচীন জনপদ। কীর্ত্তিপাশা জমিদার বাড়িটি এ অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। কিন্তু এ পুরাকীর্তি এখন বিলুপ্তির পথে। একই সঙ্গে হুমকিতে রয়েছে এখানকার অন্যান্য ঐতিহাসিক নিদর্শনও। যেগুলোর প্রয়োজনীয় সংরক্ষণ, সংস্কার ও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে গড়ে উঠতে পারে দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র।
তারা আরও জানান- উনিশ শতকের প্রথম দিকে বিক্রমপুর পোরাগাছার রাজারাম সেন গুপ্ত কীর্ত্তিপাশায় আসেন। তিনি তার দুই ছেলে কৃষ্ণ কুমার সেনগুপ্ত ও দেবীচরণ সেনগুপ্তের জন্য পূর্ববাড়ি ও পশ্চিমবাড়ি পত্তন করেন, যা পরবর্তীতে দশ আনার বড় হিস্যা ও ছয় আনার ছোট হিস্যা জমিদার বাড়ি হিসেবে পরিচিত হয়। কালের বিবর্তনে ছোট হিস্যার সব নিদর্শন আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আর বড় হিস্যার অতীত ঐতিহ্য না থাকলেও কমলীকান্দার নবীন চন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের কারণে জমিদার বাড়ির কিছুটা এখনো টিকে আছে। ১৯৭৫ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু সংরক্ষণ আর সংস্কারের অভাবে বড় হিস্যার নাট মন্দির, হলঘর, ছোট-বড় মন্দির ও পুকুর সবই আজ ধংসের পথে।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা জানিয়েছেন- রাজা কীর্ত্তি নারায়ণের নাম অনুসারেই এ স্থানের নাম হয় কীর্ত্তিপাশা। এ বংশের সন্তান রোহিনী রায় চৌধুরী ও তপন রায় চৌধুরী দুজন বিখ্যাত ব্যক্তি। গাবখান নদীর তীরে স্টিমার ঘাট রোহিনীগঞ্জ ও ইতিহাস গ্রন্থ বাকলা রোহিনী রায় চৌধুরীর অবদান।
অনুসন্ধনে নিয়ে জানা গেছে- প্রায় দেড়শ বছর আগে কীর্ত্তিপাশার জমিদারপুত্র রাজকুমারকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। তখন তার স্ত্রীও স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যান। তার সেই সহমরণ সমাধিও এখন ধ্বংসের পথে। এছাড়া মূল জমিদার বাড়ি ও দুর্গা মন্দিরটি এখন পরিত্যক্ত হয়ে আগাছায় পূর্ণ হয়ে আছে। নাট্যশালার চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে কোনোমতে। তবে রোহিনী রায় চৌধুরীর সমাধিটি নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। আর পারিবারিক শিব মন্দির ও একটি শিব প্রতিমা এখনো টিকে আছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে- এখানে প্রতি বছর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দর্শনার্থীদের সমাগম বেশি হয়। অনেকে পিকনিক করতেও আসে। কীর্ত্তিপাশার এ জমিদার পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ অঞ্চলের উন্নয়নেও ভূমিকা রাখেন তারা। এর মধ্যে রয়েছে গাবখান নদী থেকে কীর্ত্তিপাশা পর্যন্ত খাল খনন। তারা বিভিন্ন রাস্তাও নির্মাণ করেন।
এছাড়া বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ শশী কুমার কীর্ত্তিপাশায় একটি দাতব্য চিকিত্সালয় স্থাপন করেন। এ পরিবারের চন্দ্রনাথ সেন বরিশাল শহরে সে সময়ে ভয়াবহ কলেরা রোগের চিকিত্সার জন্য একটি কলেরা ওয়ার্ড স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু তাদের এসব ঐতিহ্যের প্রায় সবই এখন বিলুপ্তপ্রায়।
এ অবস্থায় ২০০৪ সালে স্থানীয় সুশীল সমাজ ও জেলা প্রশাসনের প্রচেষ্টায় জমিদারদের কিছু ঐতিহ্যের নিদর্শন নিয়ে কীর্ত্তিপাশা জাদুঘর স্থাপন করা হয়। কিন্তু বর্তমানে জাদুঘরটি একবারেই নিষ্ক্রিয়।
এ অবস্থায় জমিদার বাড়িতে ঘুরতে আসা কয়েকজন পর্যটক জানান, কীর্ত্তিপাশা জমিদার বাড়ির নাম শুনে ঘুরতে এসে কেবল হতাশই হতে হয়েছে। তারা এ অমূল্য নিদর্শনের করুণ পরিণতি দেখে দুঃখ প্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে ঝালকাঠি সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সুলতান হোসেন খান জানিয়েছেন- জমিদার বাড়িটির ঐতিহ্য রক্ষায় প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাথে আলোচনা হয়েছে। খুলনা থেকে তাদের লোক এসে এই ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখে গেছেন। খুব শিগগিরই রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।’’