খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সাফল্য : দ্বিগুন হবে পেঁয়াজ উৎপাদন, দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানী সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

প্রকাশঃ ২০২১-০৪-১৪ - ০০:২৩

মোঃ শহীদুল হাসান:

দেশে পেয়াজের ঘাটতি পুরনে দেশীয় পেয়াজের উৎপাদন দ্বিগুন পরিমান বৃদ্ধি করে তাক লাগিযে দিয়েছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের(খুবি) গবেষকরা। শুধুমাত্র‌মাটি ও সার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশী পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সাফল্য পেয়েছেন খুবি’র সয়েল ওয়াটার এন্ড এনভায়রনমেন্ট ডিসিপ্লিনের দুই গবেষক। ইতিমধ্যেই তারা গবেষনার মাধ্যমে দেশের অধিক উৎপাদনশীল ফরিদপুরী জাতের পেঁয়াজের হেক্টর প্রতি উৎপাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। গবেষনার এই ফলাফলে দেশে পিয়াজের সম্পূর্ন চাহিদারও অধিক পেয়াজ উৎপাদন সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল, ওয়াটার এন্ড এনভায়রনমেন্ট ডিসিপ্লিনের প্রফেসর মোঃ সানাউল ইসলামের তত্ত্বাবধানে পেঁয়াজ চাষ গবেষণা প্রকল্পের গবেষক ছিলেন একই ডিসিপ্লিনের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল নিশান। গবেষনালব্ধ এই পদ্ধতিতে দেশী পিয়াজের চাষের মাধ্যমে স্বয়ংসম্পূর্নতা অর্জন ও রপ্তানীতে এক নতুন দিগন্তের সৃষ্টি হবে বলে আশা করছেন গবেষকসহ কৃষি বিশেষজ্ঞরা।

প্রধান গবেষক প্রফেসর মোঃ সানাউল ইসলাম জানান, আমাদের দেশে যে পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় তার আকার ও ওজন কম। সাধারণভাবে গড় ওজন ২০-৫০ গ্রাম। ফলে সামগ্রিক উৎপাদন অনেক কম হয়। দেশে প্রতি বছর কয়েক হাজার মেট্রিক টন পেয়াজের ঘাটতি থেকে যায়। ফলে বিদেশ থেকে আমদানী করতে প্রচুর পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়।দেশে পেয়াজের ঘাটতি পুরনে উৎপাদন বৃদ্ধির প্রত্যাশা নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল, ওয়াটার এন্ড এনভায়রনমেন্ট ডিসিপ্লিনের গবেষকরা এই প্রকল্প গ্রহন করেন। প্রকল্পের আওতায় মাটি, জৈব সার ও সেচ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফরিদপুরী দেশী জাতের পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধি নিয়ে এ গবেষণার কাজ সম্প্রতি শেষ হয়েছে।

তিনি গবেষণার তথ্য দিয়ে বলেন, গবেষণা প্লটে উৎপাদিত পেঁয়াজের আকার বড় এবং ওজন ৬০-১০০ গ্রাম পর্যন্ত। যা দেশি পেঁয়াজের ওজনের প্রায় দ্বিগুণ। এই ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করে কৃষকরা পেঁয়াজ চাষ করলে বর্তমান পেঁয়াজের ফলন শতকরা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি সম্ভব বলে প্রমানিত হয়েছে। মাটি, জৈব সার ও সেচ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশে উৎপাদন ১০ লাখ টন পর্যন্ত বৃদ্ধি সম্ভব। এছাড়া একই জমিতে আগামী ও নাবি দু’জাতের পেঁয়াজ চাষ করলে‌ ৪-৫ লাখ টন পেঁয়াজ অতিরিক্ত উৎপাদন সম্ভব।এরফলে দেশ পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ-এমনকি উদ্বৃত্ত হতে পারে।

‌প্রফেসর মোঃ সানাউল ইসলাম বলেন, কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং চাষ পদ্ধতির উন্নতি করতে পারলে অতিরিক্ত পেঁয়াজ উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের‌চাহিদা মিটিয়ে অচিরেই বিদেশে রপ্তানী করতেও সক্ষম হতে পারে। আগামী বছর এই মৌসুমে উপকূলীয় লবণাক্ত বটিয়াঘাটা-দাকোপ এলাকাতে গবেষণা চালাবেন বলে

জানান তিনি। সহগবেষক আব্দুল্লাহ আল নিশান জানান, গবেষণা প্লটের মধ্যে মাটি, সার ও সেচ‌ ব্যবস্থাপনা নেওয়ায় উৎপাদন হয়েছে হেক্টর প্রতি ১৫ টন। উৎপাদিত ৪০-৫০‌ শতাংশ পেঁয়াজের প্রতিটির গড় ওজন ছিলো ৭০-৯০ গ্রাম। ২৮ দিন বয়সের চারা ফরিদপুর থেকে এনে ১০ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মাঠে লাগানো হয়। শুষ্ক মৌসুমে (এপ্রিল-মে) গবেষণা প্লটের লবণাক্ততার মাত্রা ছিলো ৪ ডেসিসিমেন্স/মিটার। ১৮টি পর্যবেক্ষণ প্লটে এই গবেষণা পরিচালনা করা হয়।

গবেষনা প্লটের পেঁয়াজ উত্তোলন করা হয় গত ০৫ এপ্রিল। সঠিক চারা ও সারি ঘনত্ব, যথযাথ মাটি, সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করে আশাতীত ফলন পাওয়া সম্ভব হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ হাফিজুর রহমান জানান, আমাদের দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বাৎসরিক ২৪ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন হয় প্রায় ২৩ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন। পচনসহ ঘাটতি ধরা হয় সাড়ে ৭ লাখ মেট্রিক টন। যদি এই গবেষণালব্ধ পদ্ধতি বাংলাদেশের যে সকল এলাকায় দেশি পেঁয়াজ চাষ হয় সিই এলাকায় প্রয়োগ করা হয় এবং তাতে যদি আশানুরূপ ফল আসে তাহলে অবশ্যই উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব হবে। আমাদের দেশের পেঁয়াজের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানী করা যাবে। তবে এ পদ্ধতি সম্প্রসারনের আগে অনেক প্রক্রিয়া রয়েছে। বিশেষ করে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পর্যবেক্ষণ ও অনুমোদনের বিষয় রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন তিনি।

‌পেয়াজ নিয়ে নতুন এ গবেষণার বিষয়ে খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক মোঃ মফিদুল ইসলাম টুটুল বলেন, এ প্রক্রিয়ায় যদি পেঁয়াজের উৎপাদন দ্বিগুণ করা সম্ভব হয়। তাহলে আমাদের আর পেঁয়াজ বিদেশ‌ থেকে আমদানি করতে হবে না। এতে একদিকে যেমন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচবে, তেমনি অন্যদিকে ওই বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে আমরা অন্য একটি উন্নয়ন প্রকল্প করতে পারব। আমাদের দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানী করতে পারব। তাই সরকারের কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উচিত এই গবেষণার প্রকল্পটি সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসর্ম্পূনতা অর্জনে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করা।