গোপালগঞ্জ : কেউ কেউ বলছিল, খাবার ঠিক মতো পায়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি এক রোগীর মা জানিয়েছেন, পাঁচ দিন আগে তাঁর সন্তানকে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। খাবার পেয়েছেন মাত্র এক দিন। মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আরেক রোগী বলেন, দুপুরে ও রাতে আমাদের একই খাবার দেয়। শনিবার ও রবিবার পাঙ্গাশ মাছ দিয়েছিল, আজও তাই দিল। দুপর ২ টায় যা দেয় সে খাবার আবার রাত ৮টায় দেয়। সকালের রান্না করা খাবার রাতে গন্ধ হয়ে যায়। কী করব গরিব মানুষ, রোগ নিয়ে আইছি, যা দেয় তাই খাই। এ নারীর কণ্ঠে এমন আক্ষেপ ঝরলেও তিনি নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি।
সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীদের নাশতা দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু সব রোগী নাশতা পায়নি, এমন অভিযোগ পাওয়া গেল ওয়ার্ড ঘুরে। পুরুষ মেডিসিন বিভাগের ভর্তি রোগী হাসিব কাজী (৬৫) বলেন, জ্বর নিয়ে ছয় দিন ধরে হাসপাতালে আছি। এখানে যে খাবার দেয় তা খাওয়ার মতো না। ছোট ছোট পাঙ্গাশ মাছ, পানির মতো ডাল, একই খাবার আবার রাতেও দেয়। শুনছি সপ্তাহে দুই দিন মাংস দেয় কিন্তু তা তো চোখে দেখতে পারলাম না। সরকার তো টাকা কম দেয় না। সরকার দিলে কী হবে তা তো আমাগো পর্যন্ত আসে না। সোমবার সরেজমিনে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে রোগীদের কাছ থেকে খাবার নিয়ে এমন সব অভিযোগ পাওয়া গেল। জানা গেছে, গতকাল শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি ছিল ৪৩ জন। এর মধ্যে খাবার দেওয়া হয়েছে ৩১ জনের।
কম খাবার দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে দায়িত্বে সিনিয়র স্টাফ নার্স প্রভাতী রানী মল্লিক বলেন, ‘অনেকে আছে হাসপাতালের খাবার নেয় না। আবার এক দিন আগে ভর্তি রোগীদের খাবার দেওয়া হয় না। এ ভাবেই মেটানো হয়।
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার গোবরা গ্রামের হামিদা বেগম (৪৮) জানান, তিনি ডায়াবেটিসের রোগী। জ্বর নিয়ে পাঁচ দিন আগে ভর্তি হয়েছেন। তিনি বলেন, যে দিন আইছি সেই দিন একটা চাদর দিয়েছে। চাদরটা ময়লা হয়ে গেছে। কিন্তু পাল্টানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। নার্সদের বললে তারা কিছু না বলে চলে যায়। তা ছাড়া রুমের মধ্যে খুব গন্ধ। এখানে বসবাস করার মতো কোনো অবস্থা নেই।
একই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন হাসি বেগম বলেন, তিন দিন হলো ভর্তি হয়েছি। টাকা-পয়সা যা আনছিলাম তা ওষুধ কিনতে শেষ হয়ে গেছে। আমরা তো জানি, সরকারি হাসপাতালে ওষুধ দিয়ে দেয়। এখানে কোনো ওষুধ দেয় না। মাঝে মাঝে দু-একটা বড়ি দেয়। নার্সরা ওষুধ নিয়ে আসে আবার তা ফেরত নিয়ে চলে যায়।
হাসপাতালে রোগীদের খাবারের মান নিয়ে পাওয়া অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সহকারী পরিচালক ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, খাদ্য সরবরাহকারী ঠিকাদার যে পরিমাণ খাদ্য সরবরাহের জন্য প্রতিশ্রুতি বদ্ধ সেই পরিমাণ খাদ্য বুঝে নেওয়ার জন্য কুককে বলা হয়েছে।
এদিকে হাসপাতালে আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) রয়েছেন দুজন। তাঁদের মধ্যে ডা. মো: ফারুক হোসেন সপ্তাহে তিন দিন এবং মুহাম্মদ নাজমুল হক লস্কর সপ্তাহে চার দিন দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কিন্তু চলতি মাসের ২ তারিখ থেকে তিনি হাসপাতালে আসছেন না বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি আরো বলেন, নাজমুল সাহেব কী কারণে হাসপাতালে আসছেন না তা আমাদের জানানো হয়নি। তবে লোক মুখে শুনেছি, তিনি কিছু দিন যাবত অসুস্থ আছেন।
সহকারী পরিচালক আরো বলেন, জরুরি বিভাগে মাত্র একজন চিকিৎসক রয়েছেন। এই একজনকে দিয়ে এত বড় হাসপাতাল চালানো কষ্টের। হাসপাতালে মূল সমস্যা হচ্ছে লোকবল। একদিকে চিকিৎসক সংকট, অন্যদিকে কর্মচারীর অভাব।
তিনি বলেন, হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসার যন্ত্রপাতি সব থাকা সত্ত্বেও আমরা রোগীদের সেবা দিতে বেগ পাই। ১০ শয্যার একটি আইসিইউ ইউনিট তৈরি করা হয়েছে। এই ইউনিটে সব ধরনের যন্ত্রপাতি আছে। প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, নার্সসহ লোকবল নিয়োগ হলেই এটি চালু করা সম্ভব। কিন্তু এ জনবল নেই বলে ইউনিটটি পড়ে রয়েছে। ৬ শয্যার একটা ডায়ালিসিস ইউনিট চালু আছে। সেখানে মাত্র একজন টেকনিশিয়ান রয়েছেন। আমরা খুলনার বিশেষায়িত শেখ আবু নাসের হাসপাতাল থেকে সাতজন নার্সকে ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে এনে ইউনিটটি চালু রেখেছি।
গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের এহেন অবস্থা থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য
প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ স্বাস্থ্য বিভাগের উর্দ্ধতন কতৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছে ভুক্তভোগীরাসহ গোপালগঞ্জবাসী।