জেনারেল হাসপাতালে করোনা টেস্টের ফি আত্মসাতের পরিমান ১৯ কোটি!

প্রকাশঃ ২০২১-১০-০৭ - ১২:৩৭

বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তিন সদস্য কমিটি গঠন

তদন্তে  আতংকে মধ্যে হাসপাতালের কয়েকজন কর্মকর্তা

গত ১৬ দিনেও খোজ মেলেনি ল্যাব টেকনোলজিস্ট প্রকাশের

কামরুল হোসেন মনি :
২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে করোনা টেস্টের ২ কোটি ৫৭ লাখ ৫৭ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাতের ঘটনায় খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তিন সদস্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। হাসপাতালের প্যাথলজিস্ট ইনচার্জ মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট প্রকাশ কুমার দাস করোনা টেস্টের আত্মসাতের ঘটনার পর থেকে লাপাত্তা রয়েছে। গত ১৬ দিনেও তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। এদিকে কাগজ-কলমে করোনা টেস্টের আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা উৎঘাটন হলেও বাস্তবে এর পরিমান ১৯ কোটি টাকা বলে গুঞ্জন রয়েছে। এ কারণে সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ তদন্ত হলে বেরিয়ে আসতে পারে থলের বিড়াল। এ কারণে তদন্তে আতংকে মধ্যে রয়েছে হাসপাতালের কতিপয় কয়েকজন কর্মকর্তারা।
খুলনা বিভাগীয় (স্বাস্থ্য) পরিচালক ডা: জসিম উদ্দিন হাওলাদার গতকাল বুধবার দুপুরে এ প্রতিবেদককে বলেন, ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ল্যাব টেকনোলজিস্ট প্রকাশ কুমার দাসের বিরুদ্ধে করোনা টেস্টের আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় তিন সদস্য একটি তদন্ত কমিটি বোর্ড গঠন করে দিয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা: মো: মনজুরুল মুরশিদকে প্রধান করে তিন সদস্য এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
উপ-পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা: মো: মনজুরুল মুরশিদ এ প্রতিবেদককে বলেন, ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে টেস্টের ফি আত্মসাতের ঘটনায় গত ৩০ সেপ্টেম্বর তাকে প্রধান করে তিন সদস্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটিতে অন্য দুই সদস্যরা হচ্ছেন সহকারি পরিচালক (প্রশাসন) ডা: সৈয়দ রেজাউল ইসলাম অপরজন হচ্ছেন সহকারি পরিচালক ( মেডিকেল সাব ডিপো) ডা: মো: রফিকুল ইসলাম গাজী। আগামী ১৫ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত   প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) খুলনার উপ-পরিচালক মোঃ নাজমুল হাসান এ প্রতিবেদককে বলেন, মামলার জন্য এখনো কোন দিক নির্দেশা আসেনি। আগামী ২-১ দিনের মধ্যে কোন নির্দেশনা আসার সম্ভবনা রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। খুলনা সিভিল সার্জনের দায়ের করা জিডি ও লিখিত অভিযোগটি ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
খুলনা সিভিল সার্জন ডা: নিয়াজ মোহাম্মদ গতকাল বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় এ প্রতিবেদককে, এখনো ল্যাব টেকনোলজিস্ট প্রকাশ কুমার দাসের হদিস পাওয়া যায়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের থেকে তিন সদস্য তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন বলে তিনি জানতে পেরেছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বিষয়টি আমাকে অবহিত করেছেন। আমি ঢাকা থেকে খুলনা উদ্দেশ্যে রওনা দিছি। সিভিল সার্জন বলেন, করোনা টেস্টের ফি টাকা জমা দেওয়ার বিষয়ে আমি নিজ উদ্যোগে এই অনিয়মের বিষয়টি খুটিয়ে খুটিয়ে বের করি। পরে বিষয়টি আমার সন্দেহ হলে তদন্ত কমিটি গঠন করি। এর পরই তো উম্মোচন হলো টেস্টের ফি টাকা আত্মসাতের ঘটনা। তিনি বলেন, আমি তো এখানে যোগদান করেছি কয়েক মাস হলো। কিন্তু হাসপাতালে করোনা টেস্টের ফি নেয়া শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। এখন তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে, তদন্তে যে দোষী সাভ্যস্ত হবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন। সে যে-ই হোক না কেনো।
হাসপাতালের নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, করোনা শুরুর প্রথম দিকে সদর হাসপাতালে করোনা টেস্টের জন্য সাধারণ মানুষদের বাসায় গিয়ে করোনা টেস্টের জন্য শ্যাম্পল কালেকশনের জন্য নেয়া হতো ১ হাজার টাকা করে এবং হাসপাতালে টেস্টের জন্য নেওয়া হতো ৫০০ টাকা।  পরবর্তীতে নেয়া শুরু করে ৩০০ ও ৫০০ টাকা। এছাড়া বিদেশগামীদের সাড়ে ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা করোনা টেস্টের জন্য নেওয়া হতো। এসব কিছুর দায়িত্বে ছিলেন ল্যাব ইনচার্জ মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট প্রকাশ কুমার দাসের। পাশাপাশি তিনি হাসপাতালের ল্যাব ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করতেন। কাগজ-কলমে তদন্তে বেরিয়ে আসে ২০২০ সালের জুলাই থেকে চলতি (২০২১) বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত করোনা পরীক্ষার ইউজার ফি বাবদ মোট ৪ কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা আদায় হলেও সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৬৬ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। ল্যাব টেকনোলজিস্ট ও ল্যাব ইনচার্জ প্রকাশ কুমার দাস বাকি ২ কোটি ৫৭ লাখ ৯৭ হাজার টাকা জমা দেননি। ওই সূত্র মতে, টেস্টের ফি টাকার রশিদ প্রথমদিকে অধিকাংশই সাধারণ রোগীদেরকে দেওয়া হতো না। এমনিক বাসায় গিয়ে করোনা টেস্টের জন্য শ্যাম্পল কালেকশন এর জন্য ১ হাজার টাকা রোগীদের কাছ থেকে নিতো সেই রশিদও দেওয়া হতো না। এমনকি টাকা জমার রশিদ’ও ভুয়া তৈরি করা হয়েছিলো। যার ফলে ওই সব টেস্টের ফি কতো টাকা তা কাগজ-কলমে কোন প্রমানও নেই। যা হাসপাতালে অনেকই বিষয়টি আচ করতে পেরেছেন। যার কারণে কাগজ কলমে আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা উম্মোচন হলেও বাস্তবে এর পরিমান ১৯ কোটি টাকা বলে সূত্রটির দাবি।
সূত্র মতে, এসব বিষয়ে মাথায় নিয়ে তদন্ত কমিটি সুষ্ঠ ও  নিরপেক্ষ তদন্ত করলে হাসপাতালে অনেকই জড়িয়ে পড়বেন। এর মধ্যে হাসপাতালের আরএমও ডা: এস এম মুরাদ হোসেন। কারণ করোনা শুরু থেকেই যাবতীয় টেস্টের বিষয়ে তার দেখার দায়িত্ব ছিলো। এছাড়া হাসপাতালের ক্যাশিয়ার তপতী সরকার ওই সব অনিয়ম বুঝতে পেরে নিজেও চুপচাপ ছিলেন। কারণ তিনিও ওই অনিয়মের ঘটনায় সহযোগিতায় ছিলেন। তা না হলে তিনি শুরু থেকেই এই বিষয়ে কেনো অভিযোগ দেননি। সাবেক হাসপাতালের প্রধান সহকারি কাম হিসাবরক্ষক মো: শাহিন মোল্ল্যাও টাকার অনিয়মের বিষয়টিও জানতেন। কারণ তাকে হাসপাতালের ক্যাশিয়ার তপতী সরকার তাকে বিষয়টি অবহিত করেছিলেন। যার কারণে এই টাকার আত্মসাতের সম্পৃক্ততা ঘটনায় মো: শাহিন মোল্ল্যাও জড়িয়ে পড়তে পারেন।
জানা গেছে, বর্তমান সিভিল সার্জন ডা: নিয়াজ মোহাম্মদ করোনা টেস্টের ফি এর টাকা গড়মিলের বিষয়টি আচ করতে পারে নিজ উদ্যোগে এ বিষয়ে তদারিক শুরু করেন। তখন থেকেই প্যাথলজি বিভাগের সম্পৃক্ততা সকলের টনক নড়ে। তখন আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসতে থাকে টেস্টের ফি টাকা নিয়ে ব্যাপক দুর্ণীতি ও অনিয়মের ঘটনা। এরই ধারাবাহিকতায় হাসপাতালের ইউজার ফি সঠিকভাবে নিরুপনের জন্য গত চলতি বছরের গত ২২ আগষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। খুলনা সিভিল সার্জন ডা: নিয়াজ মোহাম্মদকে প্রধান করে ৫ সদস্য তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। গঠিত কমিটি গত ১৬ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন দাখিল করে। তদন্তে বেরিয়ে আসে ল্যাব টেকনোলজিস্ট ও ল্যাব ইনচার্জ প্রকাশ কুমার দাস বাকি ২ কোটি ৫৭ লাখ ৯৭ হাজার টাকা জমা দেননি। ওই টাকা কেন সরকারি কোষাগারে জমা দেননি তার জবাব দেয়ার জন্য গত ২০ সেপ্টেম্বর কৈফিয়ত তলব করা হয়। কিন্তু দু’দিন অতিবাহিত হওয়ার পর গত ২৩ সেপ্টেম্বর দুপুরের পর থেকে মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট (ল্যাব:) প্রকাশ কুমার দাস গা ঢাকা দেন। ওইদিনের পর থেকে তার ব্যবহৃত মোবাইলও বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর গত ১৬ দিন অতিবাহিত হলেও তার কোন হদিস পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, করোনা শুরুর প্রথম দিকে সদর হাসপাতালে করোনা টেস্টের জন্য সাধারণ মানুষদের বাসায় গিয়ে করোনা টেস্টের জন্য শ্যাম্পল কালেকশনের জন্য নেয়া হতো ১ হাজার টাকা করে এবং হাসপাতালে টেস্টের জন্য নেওয়া হতো ৫০০ টাকা।  পরবর্তীতে নেয়া শুরু করে ৩০০ ও ৫০০ টাকা। এছাড়া বিদেশগামীদের সাড়ে ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা করোনা টেস্টের জন্য নেওয়া হতো। এসব কিছুর দায়িত্বে ছিলেন ল্যাব ইনচার্জ মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট প্রকাশ কুমার দাসের। পাশাপাশি তিনি হাসপাতালের ল্যাব ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করতেন।