মো:নজরুল ইসলাম,ঝালকাঠি : করোনা কিংবা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হলে লাশের গোসল, জানাজা ও দাফন নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন পরিবার। প্রতিবেশীদের চাপের মধ্যে গৃহবন্দিও হয়েছেন মৃত ব্যক্তির স্বজনরা। লাশ নিয়ে দুর্বিষহ রাত কাটাতের হয়েছে তাদের। লাশ দাফন না করানোর জন্যও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় মৃতের পরিবারকে। লাশ বহণের খাট নিয়েও শুরু হয় হয়রানি। এ অবস্থায় রোদ, বৃষ্টি, ঝড়সহ নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে ঝালকাঠির নলছিটিতে তিন মুফতির নেতৃত্বে গঠিত শাবাব ফাউন্ডেশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
করোনা দুর্যোগে মানুষের পাশে থাকার লক্ষ্য নিয়েই শাবাব ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়। ১৩ জন সদস্য এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত ও উপসর্গ নিয়ে মৃত পাঁচজনের লাশ দাফন করেন। তাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তারা। পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) দিয়ে সংগঠনকে কাজ করার উৎসাহ দিচ্ছেন অনেকেই। দুরোনা দুঃসময়ে লাশ দাফন করে ইতোমধ্যেই সংগঠনটি মানবতার ফেরিওয়ালা উপাধি পেয়েছে স্থানীয়দের কাছ থেকে।
জানা যায়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্কত হয়ে পড়েছে পুরোদেশ। ঝালকাঠি জেলায় এখন পর্যন্ত ৫২ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে নলছিটি ও কাঁঠালিয়ায় দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। অন্যরা বাড়িতে আইসোলেশনে রয়েছেন। তবে উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন অনেকেই। তাদের পাঁচজনই নলছিটিতে। এই পাঁচজনের দাফন কার্য সম্পন্ন করে শাবাব ফাউন্ডেশন।
শাবাব ফাউন্ডেশন জানায়, তিনজন মুফতির নেতৃত্বে শাবাব ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়। এরা হলেন মুফতি জায়নুল আবেদীন, মুফতি হানযালা নোমানী, মুফতি সাইফুল ইসলাম, ব্যবসায়ী জামাল আব্দুন নাসের, নাসিম সরদার, হাসিবুল হাসান সবুজ, শাহাদাত ফকির, শিক্ষক মর্তুজা আলী মামুন, মাহাদি হাসান, মো. জুয়েল, মো. আসাদুজ্জামান, মো. নয়ন ও মো. রিভান।
গত ১৩ মে নলছিটি উপজেলার সুবিদপুর ইউনিয়নের ভোজপুর গ্রামে জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও গলা ব্যাথা নিয়ে ঢাকা থেকে আসা নাসির উদ্দিন (৩৬) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। প্রতিবেশীরা তার লাশ দাফনে বাধা দেয়। এমনকি মসজিদ থেকে লাশ বহণের খাট নিতেওয় হয়রানি করা হয়। ঘর থেকে মৃত ব্যক্তির স্বজনরা কেউ বের হতে পারছিল না। খবর পেয়ে উপজেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে শাবাব ফাউন্ডেশনের সদস্যরা ছুটে যায় ওই বাড়িতে। তাঁরা লাশ দাফনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। যদিও তার নমুনা সংগ্রহের রিপোর্ট নেগেটিভ আসে।
গত ১৭ মার্চ করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন নলছিটি পৌরসভার নাঙ্গুলী এলাকার তছলিম খান (৩৭)। তিনি নারায়ণগঞ্জ থেকে পালিয়ে গ্রামের বাড়িতে আসেন। মারা যাওয়ার পরে তার আশেপাশের বাড়ির লোকজন সবাই অন্যত্র চলে যায়। লাশ দাফনেও কেউ এগিয়ে আসছিল না। এমন খবর পেয়ে সাবাব ফাউন্ডেশনের সদস্য লাশ দাফন করেন।
এর পরে ২৬ মে রানাপাশা গ্রামের মনিরুজ্জামান মানিক (৪০), ২৮ মে জুরকাঠি গ্রামের শহিদুল ইসলাম (৪৫) ও নাঙ্গুলী এলাকার রফিকুল ইসলামের (৬৫) লাশ দাফন করে শাবাব ফাউন্ডেশন। এরা প্রত্যেই করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
শাবাব ফাউন্ডেশনের আহ্বায়ক মুফতি জায়নুল আবেদীন বলেন, আমরা মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছি। যেখানে মানুষ লাশ দাফন করতে পারছে না, অনেকে ভয়ে জানাজায় আসছেন না; আমরা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। উপজেলার যেখানেই আমাদের খবর দেওয়া হবে, আমরা সেখানে গিয়েই মৃত ব্যক্তির লাশ দাফন করে আসবো।
সংগঠনের সদস্য সচিব মুফতি হানযালা নোমানী বলেন, করোনা ছাড়াও আমাদের এ ধরণের সেবামূলক কাজ সবসময়ই চলবে। করোনাকালে আমাদের পর্যপ্ত পিপিই নেই। যারা ইতোমধ্যে দান করেছিলেন, সেগুলো শেষের পথে। লাশ দাফনের পরে এগুলো পুড়িয়ে ফেলতে হয়। আমাদের সংগঠনকে পর্যাপ্ত পিপিই সুবিধা দিয়ে মানুষের লাশ দাফনের সহযোগিতা করার দাবি জানাচ্ছি সরকারের কাছে। ইতোমধ্যে আমাদের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুম্পা সিকদার কয়েক সেট পিপিই দিয়েছেন। তিনি এবং থানার ওসি শাখাওয়াত হোসেনও আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।
এ বিষয় নলছিটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুম্পা সিকদার বলেন, লাশ দাফনের জন্য আমরা শাবাব ফাউন্ডেশনকে অনুমতি দিয়েছি। তাদের পিপিই দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। প্রয়োজনে সব ধরণের সহযোগিতা করা হবে এ সংগঠনকে। কারণ তারা মানবতার ফেরিওয়ালা, তাদের সাহস দেখে আমি মুগ্ধ।