চট্টগ্রাম ব্যুরো: বাংলাদেশ রেলওয়ে সমবায় ঋণদান (সিসিএস) সমিতির পরিচালক (এলাকা নং ১) কর্য সাবকমিটির অবৈধ সভাপতি মো. মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
পৃথিবীর জুড়ে করোনার জালে ছকে বাঁধা জীবন। মুদি দোকান থেকে ঘরের দুয়ার পর্যন্ত করোনা শিখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে অভাবের সংজ্ঞা। সংসারের এমন টানা পোড়েনের মুখে নিজ বেতনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিপরীতে বাংলাদেশ রেলওয়ে সমবায় ঋণদান সমিতির (সিসিএস) কাছে লোনের আবেদন করেছিলেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের একাধিক কর্মচারী।
সেই আবেদন মঞ্জুরও হয়েছে। কিন্তু সেই ঋণের টাকা কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সমিতির পরিচালক (এলাকা নং ১) ও কর্য সাবকমিটির সভাপতি মো. মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায় মিজানুর রহমান ২ নং এলাকার সদস্য হলেও জোরপূর্বক ১ নং এলাকার কার্য সাব-কমিটির সভাপতি পদ করে আছেন অসহায় কর্মচারীদের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য।
অনুসন্ধানে ভুক্তভোগী পূর্বাঞ্চলের সিসিএস দপ্তরের অফিস সহকারী কামরুন নাহার, ওয়েম্যান বিষু ঘোষ (চিনকিআস্তানা), নিরাপত্তা প্রহরী আবুল কালাম আজাদ (ভৈরব বাজার)। পার্বতীপুরের ড্রাইভার শাকিল চলতি বছরের বিভিন্ন সময়ে প্রত্যেকেই সাড়ে ৩ লাখ করে টাকা চেয়ে ঋণের আবেদন করেছিলেন।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, কপালে ঋণের টাকা তো জুটেইনি, উল্টো ঋণের আবেদন ও ইস্যু হওয়ার প্রেক্ষিতে মাসিক বেতনটুকুও কেটে রাখা হচ্ছে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে। শুনতে অবাস্তব মনে হলেও রেলওয়েতে ঘটে চলেছে এমন তুঘলকি কাণ্ড।
সমর্থিত একটি সূত্র বলছে, শুধু সাড়ে ১৪ লাখ টাকাই নয়, সমিতি ঋণের অন্তত ৮৮ লাখ টাকা এভাবে গায়েব হয়েছে। অভিযুক্ত সিসিএসের পরিচালক মিজানুর রহমান বর্তমানে সিআরবির রেলওয়ে হাসপাতালে স্টুয়ার্ডের দায়িত্বে আছেন।
ঋণদান সমিতির সাত পৃষ্ঠার একটি দাপ্তরিক চিঠির মাধ্যমে এসব অভিযোগের সত্যতাও খুঁজে পাওয়া গেছে। মিজানুর রহমান বরাবরে সমিতির সচিব মো. সাখাওয়াত হোসেনের লেখা ওই চিঠির একটি কপি গনমাধ্যমের হাতেও রয়েছে। সমিতির সচিব সাখাওয়াত হোসেন এর সত্যতাও নিশ্চিত করেছেন।
ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘তিনজন লিখিত অভিযোগকারীসহ অসংখ্য মৌখিক অভিযোগকারীর মঞ্জুরীকৃত ঋণের টাকা আগামী ৭ দিনের মধ্যে দপ্তরে পরিশোধের অনুরোধ রইল। অন্যথায় আপনার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।‘
এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সমিতির কাছে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছিলেন ওয়েম্যান বিষু ঘোষ। সেই অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ‘আমার নামে মঞ্জুরীকৃত টাকার চেক মিজানুর রহমান ব্যাংক থেকে উঠিয়ে নিয়েছেন। অথচ আমি টাকা বুঝে পাইনি। একজনের চেক কীভাবে অন্যজন উঠিয়ে নেয়, তা আমার বোধগম্য নয়।’
ঋণের টাকা হাতে না পেয়ে একইভাবে লিখিত অভিযোগ জানান কামরুন নাহার ও আবুল কালাম। এ বিষয়ে অফিস সহকারী কামরুন নাহার বলেন, ‘প্রায় তিন মাস ঘোরাঘুরির পরও টাকা পাইনি। পরে অনেকটা বাধ্য হয়ে অভিযোগ করেছি।’
সমিতির পরিচালক ও কর্য সাবকমিটির সভাপতি (স্টুয়ার্ড) মিজানুর রহমান অবশ্য দাবি করেন, নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির ফলে এসব অভিযোগ উঠে এসেছে। অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এগুলো আসলে..অল্প কিছু টাকা মিস গাইড ছিল। নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির কারণে এটা হয়েছে। এটা যেহেতু অফিসিয়াল বিষয়, প্রায় নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।’
অসংখ্য গ্রাহকের প্রায় ৮৮ লাখ টাকার হদিস না পাওয়ার গুঞ্জনের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা সঠিক নয়। সম্পূর্ণ বানোয়াট।’
এদিকে অবিলম্বে রেলওয়ে সমবায় ঋণদান সমিতির কার্যক্রম বন্ধের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি। সংগঠনিটর সভাপতি মো. মনিরুজ্জামান মনির বলেন, ‘রেলওয়ে সমবায় ঋণদান সমিতি বাংলাদেশ রেলওয়ের কোনো প্রতিষ্ঠান না হয়েও অবৈধভাবে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। রেলওয়ের শ্রমিক কর্মচারীরা আবেদন করলে ঋণ পাওয়ার আগেই বেতন থেকে টাকা কাটা হচ্ছে। ঋণের নামে রেলওয়ের গরীব এসব কর্মচারীদের টাকা প্রাপ্তি স্বীকার ছাড়াই তুলে নিচ্ছে একটি চক্র।’
তিনি এও বলেন, ‘সিসিএস লোন নিতে রেলওয়ের শ্রমিক-কর্মচারীদের ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। সমিতির প্রায় ৩২ কর্মচারী রেলওয়েতে চাকরি না করেও বাসা ব্যবহারসহ রেলওয়ের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। অথচ রেলওয়ে শ্রমিক-কর্মচারীরা বাসা পাচ্ছেন না।’
সোসাইটির সভাপতি আরও বলেন, ‘সিসিএসের চক্রবৃদ্ধি সুদের কারণে রেলওয়ে অনেক গরীব শ্রমিক-কর্মচারী আজ পথে বসেছেন। ঋণ নিয়ে তাদের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই হয়েছে বেশি। তাই অবিলম্বে শ্রমিক-কর্মচারীদের রক্ত চোষা এই সমিতি বন্ধের দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সমিতির সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’