নিউটন দাশ, চট্টগ্রাম: রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল বাণিজ্যিক শাখার অধীনে আগামীকাল ৬ সেপ্টেম্বর ট্রেনের বেডিং ধোলাইয়ের টেন্ডার আহব্বান করা হলেও টেন্ডারের কে পাবে তা আগেই নির্ধারণ করে ফেলেছেন কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম নগরীর টাইগারপাস এলাকার আলী নামের এক টিকাদার পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের বাণিজ্যিক শাখার উচ্চমান সহকারি রেজা হায়দারের মাধ্যমে টেন্ডার পাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন।
বেডিং ওয়াশের টেন্ডার সিডিউল ক্রয় করতে যাওয়া একাধিক টিকাদার নাম প্রকাশ না শর্তে প্রতিবেদককে জানান টেন্ডার পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে টাইগারপাসের আলীর নিকট থেকে উচ্চমান সহকারি রেজা হায়দার অগ্রিম টাকা নিয়ে উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেছেন। তাই ঠিকাদার আলীর নির্দেশনা ব্যতীত কাউকে সিডিউল বিক্রি করা হচ্ছে না।
ঠিকাদাররা আরো জানান আমরা বাণিজ্যিক শাখার উচ্চমান সহকারি রেজা হায়দারের নিকট সিডিউল ক্রয় করতে গেলে তিনি নানা রকম কাজের অজুহাত দেখিয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকে, এক পর্যায়ে সিআরবি রেলওয়ে সদর দপ্তর নিয়ন্ত্রণকারী দুটি সন্ত্রাসী গ্রুপ আমাদের টেন্ডার সিডিউল না কিনে সিআরবি সদর দপ্তর থেকে চলে যাওয়ার জন্য হুমকি প্রদান করলে আমরা সিডিউল না করে চলে আসি। উক্ত অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সরেজমিনে সিআরবি পূর্বাঞ্চল রেলের বাণিজ্যিক শাখার উচ্চমান সহকারীর অফিসে গেলে তাকে অফিসে পাওয়া যায়নি অফিস সহকারি মিতুস চাকমার নিকট থেকে তাহার ফোন নাম্বার নিয়ে যোগাযোগ করা হলে টেন্ডারের সিডিউল বিক্রির দায়িত্বে থাকা উচ্চমান সহকারীর প্রতিবেদককে জানান আমি অ্যাডিশনাল চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার ( পূর্ব ) মিজানুর রহমান স্যারের ল্যাপটপ মেরামত করার জন্য বাইরে এসেছি।
তিনি প্রতিবেদককে আরও জানান টেন্ডার সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু জানতে হলে ডেপুটি চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার (পূর্ব) তৌসিয়া আহমেদ সাথে যোগাযোগ করুন।
টেন্ডার প্রক্রিয়ার অনিয়মের বিষয়ে জানার জন্য দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রাম রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বাণিজ্যিক শাখার ডেপুটি চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার (পূর্ব) তৌশিয়া আহমেদ নিকট জানতে চাইলে তিনি অনিয়মের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবেদককে জানান রেলপথ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকলেও ইজিপি টেন্ডার করা সম্ভব নয়।
পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে আমরা ওপেন টেন্ডার এর ব্যবস্থা করেছি ইতিমধ্যে চট্টগ্রামে দশটি ও ঢাকায় ছয়টি সিডিউল বিক্রি করা হয়েছে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অনিয়ম নিয়ে আরো পড়ুন:
চট্টগ্রামের পুরাতন রেলওয়ে স্টেশন ভবনের হেরিটেজ বিআর হোটেলে চলছে ইয়াবা বানিজ্য, গ্রেপ্তার দুই
কালুরঘাট সেতুর ইজারাদারের নিকট আড়াই কোটি টাকা পাওনা রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল
চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনপার্কিং সংলগ্ন গুদাম ভাড়া নিয়ে অবৈধ মার্কেট নির্মাণ
বিনা টেন্ডারে বেসরকারি ট্রেন চালাচ্ছেন পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে! রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার
বাংলাদেশ রেলওয়ে সমবায় ঋণদান সমিতির অবৈধ সভাপতি মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
টাইগারপাসের আলী টেন্ডার পাওয়ার বিষয়টি আগেভাগে নিশ্চিত হওয়ার বিষয়ে তথ্য জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। গুপ্সী বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি কয়েকটি বহুল প্রচারিত দৈনিক এর নাম উল্লেখ করলেও পত্রিকার বিজ্ঞাপন ও ছাপার তারিখ জানাতে অস্বীকৃতি প্রকাশ করেন।
বেডিং ওয়াস টেন্ডার প্রক্রিয়ার অভিযোগের বিষয় অ্যাডিশনাল চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার মিজানুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানে না বলে প্রতিবেদককে জানান।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের বাণিজ্যিক শাখার উচ্চমান সহকারি রেজা হায়দারের মাধ্যমে ১৫% কমিশন চুক্তিতে অগ্রিম টাকা প্রদান কারী নগরীর টাইগারপাস এলাকার ঠিকাদার মোহাম্মদ আলী মোহাম্মদ আলীর মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ করে পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চিফ কমাশিয়াল ম্যানেজার নাজমুল ইসলামকে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।
রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব) জাহাঙ্গীর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিবেদককে জানান টেন্ডার প্রক্রিয়া কোনরকম অনিয়ম ও অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সিসিএম অফিসের উচ্চমান সহকারী রেজা হায়াতের বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ আমলে নিচ্ছে না প্রশাসন:-
উচ্চমান সহকারী রেজা হায়াতের ইশারায় চলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সিসিএম অফিস, জানা যায় এই অফিসের এক উচ্চমান সহকারীর দাপটে বিল নিয়ে চলছে এমন নয়ছয়। তার ‘কেরামতি’তে এক খাতের বরাদ্দ চলে যায় অন্যখাতে। এখন তার কারণে দিশেহারা হয়ে পড়েছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ঠিকাদাররা। যার দাপটে এই অবস্থা সেই উচ্চমান সহকারীর নাম রেজা হায়াত। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সিসিএম অফিসের একপ্রকার হর্তাকর্তাই তিনি।
ঠিকাদারদের অভিযোগ, একই পদে ১০ বছর ‘রাজত্ব’ করা রেজা হায়াতের নেশা কমিশন! এই নেশায় বুদ হয়ে থাকা এই কর্মচারীর কথাই নাকি এই অফিসে শেষ কথা! অবাক করা বিষয় হল, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তার ইচ্ছাতেই বরাদ্দ ঢেলে সাজায় বিভিন্ন খাতে।
অভিযোগ রয়েছে, রেজা হায়াতের ইশারা মিললেই তার ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারদের কপালে জোটে বিল। আর বাকিদের বিল-ভাগ্যের চাকা থাকে থমকে।
রেলওয়ের সিসিএম অফিস সূত্র জানায়, আইবাস সিস্টেম কোড ২৮০১ খাতে সাধারণ প্রশাসনের অনুকূলে রিভার্স বাজেটে মেরামত খাতসহ বিভিন্ন খাতে চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজারের (পূর্ব) অনূকূলে থেকে বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়। গত মার্চ মাসেই বরাদ্দ আসে আড়াই কোটি টাকা।
এই দফতরের মাধ্যমে বিভাগীয় বাণিজ্যিক দফতর ঢাকা ও চট্টগ্রাম খাতে অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার কথা থাকলেও তা নিয়ম অনুযায়ী বণ্টন না করে উচ্চমান সহকারী রেজা রাহাত আটকে রাখেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ঠিকাদারদের অভিযোগ, বরাদ্দের পরিবর্তে রেজা রাহাত তার সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে বলেন ঠিকাদারদের। নিজের কমিশন নিশ্চিত করার পর বরাদ্দ প্রক্রিয়া চালুর অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে।
ঠিকাদারদের দাবি, আড়াই কোটি টাকা বরাদ্দ এলেও তা দফতরগুলোতে পোস্টিং না দিয়ে আটকে রেখে কমিশন আদায় করছে এ উচ্চমান সহকারী রেজা হায়াত।
দায়িত্বে থাকা রেজা হায়াতের কাছে কত টাকা বরাদ্দ এসেছে জানতে চাইলে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি এসব জানিনা। ঢাকা হিসাব বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি শুভ’র কাছ থেকে জেনে নিন।’ কমিশন আদায়ের অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি।
এ বিষয়ে ঢাকা অর্থ বিভাগের কর্মকর্তা শুভ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা রেজা হায়াতই বলবেন।’ কম্পিউটার মেরামত খাতে কত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে শুভ বলেন, ‘কম্পিউটার মেরামত খাতে কোনো বরাদ্দ দেয়নি।’
অথচ নথি অনুযায়ী ২০২০-২১ অর্থ বছরে অফিস কম্পিউটার মেরামত বাবদ ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দের সত্যতা মিলেছে।
ঠিকাদারদের প্রশ্ন, বরাদ্দের বিষয়ে কেন রেজা হায়াত কোনো তথ্য দেন না? বরাদ্দ দেওয়ার পরও কম্পিউটার মেরামত খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি উল্লেখ করে প্রচার চালানোর নেপথ্যে কি তা তদন্ত হওয়া উচিত। এ দুই জনের যোগসাজশেই কি সিসিএম অফিসে ঠিকাদারদের বিলের বরাদ্দ নিয়ে নয়ছয় চলছে?
জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে মেরামত খাতে বাজেট না থাকায় বহু ক্ষুদ্র ঠিকাদার কাজ শেষ করেও বিল নিতে পারেননি। রেলওয়ে বাণিজ্যিক বিভাগ ঢাকা ও চট্টগ্রামে চিঠি দিয়ে ২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেট থেকে যতটা সম্ভব ২০১৯-২০ অর্থ বছরের বকেয়া নির্বাহ করার জন্য অনুরোধ করে।
চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে আসা একটি বরাদ্দ তালিকায় ২০২০-২১ অর্থ বছরে অফিস আসবাব মেরামত বাবদ ২৪ লাখ, কম্পিউটার মেরামত খাত ৭লাখ ৫০ হাজার, অফিস সরঞ্জামাদী বাবদ ১৫ লাখ, আসবাবপত্র বাবদ ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ আসার প্রমাণ মিলে। এছাড়া ৩২৫৫১০৫ কোড বাবদ বরাদ্দ আসে ৪৬ লাখ টাকা বরাদ্দ।
সিসিএম দফতর ওই খাত থেকে ২৬ লাখ টাকা আইন বহির্ভূতভাবে কেটে রাখে বলে অভিযোগ রয়েছে।
একাধিক ঠিকাদার অভিযোগ করেন, এক পদে ১০ বছর থাকা রেজা হায়াত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অলিখিত পার্টনারশীপে ব্যবসা করেন রেলপাড়ায়।
রেলওয়ের ঠিকাদার মহসিন গণমাধ্যমে অভিযোগ করেন, ‘চট্টগ্রামে রেলওয়ের দুই মাফিয়ার একজনকে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলে বদলী করা হলেও দ্বিতীয় মাফিয়া রেজা হায়াত এক পদেই আছেন ১০ বছর। বলা চলে সিসিএম দফতরে তার কথা শুনেই কাজ করতে হয় কর্মকর্তাদের।’
এদিকে অভিযোগ উঠেছে, প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার সুইপিংয়ের কাজ সিসিএম দফতর থেকে রেজা হায়াতের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে একটি সিন্ডিকেট। এই কাজগুলো ভাগিয়ে নিতে এই সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে কয়েকদিন ধরে।