বটিয়াঘাটা প্রতিনিধিঃ খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার আমিরপুর ইউনিয়নের খারাবাদ বাইনতলা পুলিশ ফাঁড়ির সামনে স্কুল ছাত্রীরা দীর্ঘদিন যৌন হয়রানি শিকার হচ্ছিল। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকেও খারাবাদ বাইনতলা স্কুল এন্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্রীদের যৌন উত্যক্ত করে পুলিশ ফাঁড়ির পাঁচ সদস্য। তাৎক্ষনিকভাবে এঘটনার প্রতিবাদ করলে ওই পাঁচ পুলিশ সদস্য একজন ছাত্রীর ভাই তারেক মাহমুদকে বেধড়ক মারপিট করে। এখবর জানাজানি হলে পুলিশ ফাঁড়ি ঘেরাও এবং যৌন উত্যক্তকারী পুলিশ সদস্যদের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ করে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। পরে তাৎক্ষনিকভাবে ওই পাঁচ পুলিশ সদস্যকে ক্লোজড করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ নাঈমুল হক পরিস্থিতি শান্ত করেন। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা হলেন- পুলিশ কনস্টেবল মোঃ নাঈমুল ইসলাম (কং নং-২২০৮), মোঃ মামুন কবির (কং নং-২০৯৭), রিয়াজ হোসেন (কং নং-৯৮৫), আবির হোসেন (কং নং-১৬৮৩) ও নায়েক মোঃ জাহিদুল ইসলাম (ন/৪১৪)। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পুলিশের নানাবিধ অত্যাচারে অতিষ্ঠ জনগন ক্ষোভে ফুঁসছিল।
আমিরপুর ইউনিয়ন পরিষদের বিপরীতে অবস্থিত তারেক কম্পিউটার্স’র মালিক শেখ তারেক মাহমুদ বলেন, “খারাবাদ বাইনতলা স্কুল এন্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্রী আমার বোন রাবেয়া খাতুন কেয়া, তার বান্ধবী শাবনাম হাবিবা, আফরোজা, তন্বী, রেহেনা ও ঐশিসহ কয়েকজন সহপার্টি শুভেচ্ছা কোচিং থেকে পড়ে স্কুলে যাচ্ছিল। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আমিরপুর ইউনিয়ন পরিষদের দ্বিতীয় তলা থেকে উচ্চস্বরে খারাবাদ বাইনতলা পুলিশ ফাঁড়ির কয়েকজন সদস্য আমার বোনসহ তার সহপার্টির আজে-বাজে মন্তব্য করতে থাকে। তাদের মোবাইল নম্বর চায়। এতেও কর্ণপাত না করায় পুলিশ সদস্যরা তাদেরকে বলে- ‘কি সুন্দরীরা কথা বলছো না কেন? আমাদের কি পছন্দ হয় না? এইটা আমার, ওইটা তোর…!’ এভাবে অকথ্য ভাষায় নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারার করছিল উচ্চস্বরে। এসব শুনে সহ্য করতে না পেরে আমিও চিৎকার করে বলি, পুলিশ হয়ে আপনারা এসব কি বলছেন? ঘরের মা-বোনও কি আপনাদের জন্য বাইরে বের হতে পারবে না? এ কথা বলে বোনদের স্কুলে চলে যেতে নির্দেশ দিয়ে আমি আমার প্রতিষ্ঠানে ফিরে আসি। পরে ক্যাম্পের ওইসব পুলিশ সদস্যরা দুই তলায় দাড়িয়ে আমাকে উচ্চস্বরে ফাঁড়িতে ডাকতে থাকে। আমি চা খাচ্ছিলাম তখন; তাদের বলেছি- চা টা খেয়েই আসছি। দেরি সহ্য না করে ওরা ৫/৬জন এসে আমার প্রতিষ্ঠানটি ভাঙচুর ও লুটপাট করতে থাকে, সন্ত্রাসীদের মতোই। আমি বাঁধা দিলে আমাকে প্রচন্ড পেটানো শুরু করে ৫-৬জন মিলে। প্রচুর মেরেছে আমাকে। আজ মোটরসাইকেল কিনতে যাবো বলে আমার কাছে এক লাখ ৭২ হাজার টাকা ছিল; মারপিটের একপর্যায়ে টাকাটাও নিয়ে নেয় ওরা। শুধু মেরেই ক্ষ্যান্ত হয়নি; একপর্যায়ে আমাকে টেনে-হিচড়ে ক্যাম্পে নিয়ে যায় তারা। সেখানে নিয়ে আমাকে গুলি করে মেরে ফেলতে পরস্পর কথা বলাবালি করে। এরমধ্যে বাইরে অনেক লোকের জমায়েত হওয়ায় আমাকে আর প্রাণে মারতে পারেনি ওরা। বাইরে অনেক মানুষের চিৎকার, চেচামেচি শুনে ওরা আমাকে ছেড়ে দেয়। আপন বোনের সম্ভ্রমহানীর প্রতিবাদ করায় কি এই শাস্তি পুলিশের? এখন তো আমি নিজেই জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। না জানি কোন সময় আমাকে পুলিশ কোন মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়।”
সরেজমিনে দেখা গেছে, তারেক মাহমুদের পিটে, বুকে, হাতে-পায় রক্তাক্ত জখমের চিহৃ রয়েছে। প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশ ফাঁড়ি ঘেরাও করে রাখে সকাল ১০টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত।
তারেক মাহমুদের পিতা খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক অনির্বাণ’র স্থানীয় প্রতিনিধি শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “আমি সাংবাদিক, আর আমার মেয়েকে যৌন উত্যক্ত করেছে পুলিশ; সেই যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় আমার ছেলেকে বেধম পিটিয়েছে পুলিশ সদস্যরা। এ কোন দেশে বাস করছি আমরা। শুধু ক্লোজড করে নিলেই এদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হবে না; অবিলম্বে এমন দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দেয়া হোক, যাতে দেশের আর কোন মেয়ে স্কুলে যাতয়াতের পথে যৌন হয়রানির শিকার না হয়। না জানি পুলিশ আমার ছেলেটাকে কোন ক্ষতি করে না দেয় এ আতঙ্ক এখন আমার।”
আমিরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিএম মিজানুর রহমান মিলন বলেন, “এধরণের ঘটনা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। ক্লোজড করাটাই বিক্ষুব্ধ জনগনের দাবি অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তি দিয়ে প্রমাণ করা হোক পুলিশ জনগনের বন্ধু। না হলে পুলিশের প্রতি জনগনের আস্থা হারাবে। ইতিপূর্বেও খারাবাদ বাইতলা স্কুল এন্ড কলেজের একজন ছাত্রীকে এই ক্যাম্পের একজন পুলিশ সদস্য যৌন উত্যক্ত করেছিলেন। সে সময় স্কুল কর্তৃপক্ষ লিখিত দরখস্ত দিলে সেই পুলিশ সদস্যকে এখান থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছিল। তবে কেন এধরণের ঘটনা পুনঃরায় ঘটলো?”
স্থানীয় বাসিন্দা মোঃ মিঠুন বলেন, “খারাবাদ বাইনতলা পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা খারাবাদ-মাথা ভাঙ্গা ঘাটের চরে গিয়ে সন্ধ্যার পরে গাঁজা সেবন করে। নানাভাবে স্থানীয়দের হয়রানি করে এরা। পুলিশ ফাঁড়ির সামনে দিয়ে মেয়েরা গেলে পুলিশ তাদের নম্বর চায়, মোবাইলে ছবি তোলে, শীশ দেয়। ওই মেয়েদের নম্বরের জন্য পুলিশ মোটরসাইকেল চালিয়ে তার বাড়ী পর্যন্ত যায়। আর প্রতিবাদ করতে আসলে, আজকের মতো মারপিট খেতে হয়। দীর্ঘদিন এধরণের অপকর্ম চললেও কোন অফিসার এদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি।”
একই এলাকার বাসিন্দা মোঃ খায়রুল ইসলাম বলেন, “স্কুলে ও কোচিংয়ে যাতয়াতের আমাদের বোনদের উদ্দেশ্যে করে এই ফাঁড়ির পুলিশের আজেবাজে কথা বলে। আজ আমার বোনরা যাচ্ছে ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে, এ খবর শুনে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মোঃ নাঈমুল হক, বটিয়াঘাটা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোজাম্মেল হকসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। আমিরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বর ও স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে দীর্ঘ সমাঝোতা বৈঠকের পর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ নাঈমুল হক বলেন, “অভিযুক্ত পাঁচ পুলিশ সদস্যকে খারাবাদ বাইনতলা পুলিশ ফাঁড়ি থেকে প্রত্যাহার ও পুলিশ লাইনে ক্লোজড করা হলো। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর ভবিষ্যতে এ ফাঁড়ির কোন পুলিশ সদস্য কোনধরণের অপকর্মের সাথে জড়িয়ে পড়বে না বলে এলাকাবাসীর কাছে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।”
তিনি আরও বলেন, “এই ঘটনার সাথে পাঁচজন জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে আমরা পুরো ক্যাম্পের স্টাফ সকলকেই সরিয়ে নিয়ে নতুন পুলিশ সদস্য আগামীকাল (আজ) মোতায়েন করা হবে। ওই ছেলেটার কাছে টাকা ছিল কি না, সেটা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সেটাও তদন্ত করে দেখা হবে।”