খুলনা : খুলনায় পাচার হওয়া ২২ মাসের শিশু মৌসুম গাইন নীলকে ৬ মাসেও উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। শিশুটিকে উদ্ধারের জন্য ৬ মাস আগে ঢাকার আদালত থেকে সার্চ ওয়ারেন্ট জারি হয়। এই ওয়ারেন্ট খুলনার দাকোপ থানার হাতে থাকার পরও শিশুটিকে উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। শিশুটির মা ফরিদা ইয়াসমিন মনি ঢাকা-খুলনা ছুটে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু কোনও সুরাহাই হচ্ছে না। তদন্ত কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের অভিমত, এ ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলায় তথ্যগত বেশ কিছু অমিলের কারণে প্রশাসনও তদন্ত কাজের জটিলতায় রয়েছে। আইনি মারপ্যাঁচের বেড়াজালে শিশু নীল উদ্ধার প্রক্রিয়া চলছে ধীরলয়ে।
খুলনার দাকোপ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাহাবুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ঢাকার আদালত থেকে পাঠানো একটি সার্চ ওয়ারেন্ট পেয়ে আমরা দাকোপ উপজেলার পোদ্দারগঞ্জ এলাকার সাহেবের আবাদ গ্রামে বিনয় গাইনের বাড়ি ও আশপাশ এলাকায় তল্লাশি চালিয়েছি। কিন্তু শিশু নীলের কোনও হদিস বা কোনও প্রকার উপস্থিতির বিষয়ে কোনও ধরনের তথ্য পাওয়া যায়নি। তারপরও ওই পরিবারের ওপর আমরা নজরদারি করছি। তিনি আরও জানান, শিশুটি পাচারের ঘটনায় খুলনার সোনাডাঙ্গা থানা ও ঢাকার আদালতে দু’টি মামলা রয়েছে। সোনাডাঙ্গা থানার মামলা তদন্ত করছে সিআইডি পুলিশ। আর দাকোপে এসেছে সার্চ ওয়ারেন্ট। দাকোপ পুলিশ কেবল সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে কাজ করছে।
নীলের মা ফরিদা ইয়াসমিন জানান, ২০১৫ সালের ১০ মার্চ ধর্মান্তরিত হওয়ার পর ৩০ মার্চ লিটনকে বিয়ে করেন। প্রাথমিকভাবে লিটনের পরিবার এই বিয়ে মেনে নিতে পারেনি। নীলের জন্ম হওয়ার পরও নানা ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। এরই অংশ হিসেবে শিশুটিকে তুলে নিয়ে লুকিয়ে রাখা হয়। তিনি অভিযোগ করেন, নীলের চাচা রিপন তাকে বিভিন্ন সময় ফোনে হুমকি ও ভয়-ভীতি দেখাচ্ছে।
সিআইডি খুলনার পরিদর্শক আবু মুসা খন্দকার বলেন, নীলের বাবা সনাতন ধর্মাবলম্বী ও মা মুসলিম। স্বামী লিটন দাকোপ উপজেলার পোদ্দারগঞ্জ এলাকার সাহেবের আবাদ গ্রামের বিনয় গাইনের ছেলে। ওই বাড়িতেও অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। কিন্তু শিশু নীলের সন্ধান মেলেনি। খুলনায় লিটনের বোনসহ আত্মীয়-স্বজনের বাসা-বাড়িতেও তল্লাশি করা হয়েছে। কিন্তু শিশুটির কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। ঢাকার মামলায় নীলের বাবা লিটনকে আসামি করা হলেও খুলনার মামলায় তাকে আসামি না করার কারণে বিষয়টি পুলিশকে ভাবিয়ে তুলেছে। এছাড়া আরও বেশ কিছু তথ্যগত গড়মিল রয়েছে দু’টি মামলায়। যা তদন্তে জটিলতা সৃষ্টি করছে। এ জটিলতার ফলে আসামিপক্ষ আইনি ফাঁক-ফোকরের সুবিধা নিচ্ছে।
তিনি আরও জানান, ৩১ অক্টোবর মামলার তদন্তভার গ্রহণ করার পর ১ নভেম্বর প্রধান আসামি রিপনকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু ঘটনাস্থল ঢাকায় হওয়ার কারণে খুলনার আদালত রিপনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেননি। রিপন ২০ দিন জেলে থাকার পর আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হন।
দাকোপের বাসিন্দা আইনজীবী শুভদ্রা সরকার বলেন, শিশুটিকে উদ্ধারের জন্য এলাকার মানুষও তৎপর রয়েছে। কিন্তু স্থানীয় কোনও লোকই শিশুটির দেখা পায়নি। আর লিটনকেও তার বাবা ত্যাজ্যপুত্র করেছে। ফলে এলাকায় লিটনেরও দেখা মিলছে না। শিশুটির সন্ধান পেতে আগে লিটনের খোঁজ পাওয়া জরুরি বলে মনে হচ্ছে। আর আদালত ও পুলিশ দু’টি মামলার তথ্যগত গড়মিলের কারণে জটিলতায় রয়েছে। এর ফলে শিশুটির ভবিষ্যৎ অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, লিটনের পরিবারের পক্ষ থেকে মনির সঙ্গে বিয়ের বিষয়টি অস্বীকার করা হচ্ছে। ফলে তারা শিশু থাকার বিষয়টিও মানতে রাজি নন। তবে শিশু নীলের মা মনির কাছে লিটনের সঙ্গে তার বিয়ে, পেটে সন্তান ধারণ ও নবজাতক থাকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ রয়েছে যা শিশুটিকে উদ্ধারে গুরুত্ব বহন করে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ১৭ এপ্রিল লিটনসহ ৩/৪ জন নীলকে ঢাকার বাসা থেকে নিয়ে যায়। এরপর ওই বছরের ২৩ এপ্রিল বিরোধ মীমাংসার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে নীলকে আনা হয়নি। এ অবস্থায় ঢাকার আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা দায়ের করে নীলের মা। এ মামলায় গত বছরের ১৯ জুলাই আদালত থেকে শিশুটিকে উদ্ধারের জন্য সার্চ ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়। এরপর গত ১০ অক্টোবর খুলনার গল্লামারী এলাকায় নীলের কাকা রিপনের সঙ্গে নীলকে দেখা যায়। সেখানে রিপনের মা ও স্ত্রী ছিলেন। এরপর খুলনার সোনাডাঙ্গা থানায় মানবপাচার আইনে ওই তিন জনের নামে মামলা দয়ের করা হয়।
মামলাটি শুরুতে পুলিশ তদন্ত করে। গত ৩১ অক্টোবর তা সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু তদন্তে কোনও অগ্রগতি হয়নি। ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে লিটনসহ তার পরিবারের সদস্যদের নামে মামলায় শিশুকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ জারি হয়। কিন্তু ৭ জানুয়ারি শুনানি শেষে আদালতে হাজিরের আদেশ এক সপ্তাহের জন্য স্ট্যান্ডওভার (মুলতবি) করেন হাইকোর্ট। শিশুটি এখনও উদ্ধার হয়নি। এ অবস্থায় ৩০ জানুয়ারি ঢাকার আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার শুনানি হয়। ওই কার্যক্রমে আসামিদের (লিটন ও তার পরিবারের সদস্য) নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।