বরাদ্দ না নিয়েই থাকছেন চিকিৎসক-কর্মচারীরা, তালিকা প্রণয়নে কমিটি গঠন
কামরুল হোসেন মনি, খুলনা : খুলনা মেডিকেল কলেজের আবাসিক ভবনের বাসা বরাদ্দ না নিয়ে বছরের পর বছর অবৈধভাবে ডাক্তার, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বসবাস করছেন। দিতে হয় না পানি ও বিদ্যুৎ বিল পর্যন্ত। হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও বহিরাগতরা সপরিবারে বসবাস করছেন। বছরের পর বছর এ অবস্থা চললেও অদৃশ্য কারণে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই। একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে ভবনগুলো অবৈধ আখড়ায় পরিণত হয়েছে। কলেজের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ম্যানেজ করেই এভাবে বসবাসের সুযোগ পাচ্ছে।
খুলনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ মোঃ আব্দুল আহাদ বলেন, বর্তমানে কলেজে আবাসিক এলাকায় বসবাসকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হালনাগাদ তথ্যাদী জানতে সরেজমিন পরিদর্শন ও প্রতিবেদন তৈরির জন্য ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য কমিটির সদস্যদের আরও ১৫ দিন সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। তিনি বলেন, যারা অবৈধভাবে বসবাস করছেন তারা আর এ সুযোগ পাবে না। তবে ওই সব অনিয়ম দূর করার জন্য তিনি সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি বলেন, মৌখিকভাবে জানতে পেরেছি অবৈধ বিদ্যুৎ ও পানিও ব্যবহার করা হয়েছে। ওই সব বিষয় নিয়ে তদন্ত কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গোয়েন্দা সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসিক ভবনগুলোতে অধিকাংশ বসবাসকারীই বাসা বরাদ্দ না নিয়েই বহাল তবিয়তে বছরের পর বছর বসবাস করছেন। কলেজের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাদেও বহিরাগত ক্ষমতাসীন ব্যক্তিও বসবাস করছেন। ফলে যে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। গত বছর কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী দুলাল মাদক ও নারী কেলেঙ্কারী ঘটনায় মামলার আসামি হওয়ায় বরখাস্ত করা হয়েছিল। সে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হয়ে বাসা বরাদ্দ ছাড়াই চিকিৎসকদের নির্ধারিত বাসায় বসবাস করছেন। এছাড়া কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর মধ্যে এলএএমএস জামান উল্লাহ, সুইপার রতন, সুইপার কাওছার, টেবিল বয় আবুল হানিফ, নিরাপত্তা কর্মী মহিউদ্দিন মির্জা, এমএলএস নজরুল ইসলাম, ওহিদুল ইসলাম, সুইপার বাচ্চু, সোবহান, সিকিউরিটি কালাম, ওয়ার্ড বয় প্রবীর, জিন্নাত, বাবুর্চি রিনা বেগম, গাড়ি চালক কামরুল, আঃ হাই, রিপন, দেলোয়ার, প্যাথলজি বিভাগের ওয়াহিদসহ অনেকেই কলেজের আবাসিক ভবনের বাসা বরাদ্দ ছাড়াই বছরের পর বছর সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বসবাস করে আসছেন। এছাড়া সোনাডাঙ্গা থানাধীন স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা রুম্মান কলেজের ভবনে সপরিবারে বসবাস করছেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তিনি বসবাস করে আসছেন।
খুলনা মেডিকেল কলেজ সূত্রে জানা যায়, চতুর্থ শ্রেণির একজন কর্মচারী সরকারি বাসা বরাদ্দ নিলে তাকে মূল বেতনের ৪৫-৫০ শতাংশ সরকারকে বাড়ি ভাড়া বাবদ পরিশোধ করতে হয়।
নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী জানান, তার বর্তমানে মূল বেতন ১৪ হাজার ৭শ’ টাকা। তিনি সরকারি বাসা বরাদ্দ নেওয়ায় প্রতিমাসে মূল বেতনের ৫০ শতাংশ টাকা অ্যাকাউন্ট শাখা থেকে কেটে রাখেন। অর্থাৎ তার প্রতিমাসে ৭ হাজার ৩৫০ টাকা বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে হয়।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ওই সব অবৈধ বসবাসকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বর্তমানে কতজন কর্মকর্তা-কর্মচারী বাসা বরাদ্দ নিয়ে বসবাস করছেন তার একটি হালনাগাদ তথ্য ও প্রতিবেদন তৈরির জন্য ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। খুলনা মেডিকেল কলেজের রেসিপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ পরিতোষ কুমার চৌধুরীকে কমিটির সভাপতি করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গত ১৭ ফেব্রুয়ারি গঠন করা হয়। ওই কমিটিকে আগামী ৭ দিনের মধ্যে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে ওই তদন্ত কমিটি ৭ দিন সময় আরো বাড়িয়ে নেন। পুনরায় আরো ১৫ দিন সময় বর্ধিত করে এ মাসেই তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়। অন্যান্য সদস্যরা হচ্ছেন খুলনা মেডিকেল কলেজের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ শ.র.ম ছাইফুল আজিজ, খুলনা মেডিকেল কলেজের শিশু সার্জারি সহকারী অধ্যাপক ডাঃ শ.ম. জুলকার নাঈম, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আর এস ডাঃ বিপ্লব বিশ্বাস ও সদস্য সচিব হিসেবে খুলনা মেডিকেল কলেজের সচিব মোঃ মনিরুজ্জামান তদন্ত কমিটিতে নিযুক্ত রয়েছেন।
সূত্র মতে, কলেজের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর কলেজের আবাসিক ভবনের বাসা বরাদ্দ না নিয়েই এভাবে সরকারি কোষাগারে বাড়ি ভাড়া না দিয়ে বহাল তবিয়তে বসবাস করে আসছেন। কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের একাধিক নেতা ও সদস্য কোন রকম বাসা বরাদ্দ ছাড়াই মেডিকেল কলেজের কোয়ার্টারে বসবাস করছেন। কলেজের কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি জামান রয়েছে একটি চিকিৎসক লেভেলের বাসায়। ওই সব অবৈধ বসবাসকারীরা ডাবল ডাবল হিটার অবৈধভাবে চালিয়ে আসছেন। পানির বিলও পরিশোধ করা লাগে না তাদের। কলেজের পরিত্যক্ত আবাসিক ভবনে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ লাগিয়ে সেখানে বসবাস করা হচ্ছে।
খুলনা মেডিকেল কলেজের রেসিপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও তদন্ত কমিটির সভাপতি ডাঃ পরিতোষ কুমার চৌধুরী মঙ্গলবার বিকেলে এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি অফিসিয়াল কাজে ঢাকা মন্ত্রণালয়ে আছি। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে আরও সময়ের প্রয়োজন হওয়ায় ১৫ দিন সময় বাড়ানো হয়েছে। এ মাসের মধ্যেই তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারবেন বলে তিনি আশাবাদী।